সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা ও চিন্তার স্বাধীনতা। প্রকৃত অর্থে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হল সংবাদমাধ্যম বা প্রেসের স্বাধীনতা।
সংবাদপত্রের সঙ্গে স্বাধীনতার প্রশ্নটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মুক্ত বুদ্ধি ও বাক স্বাধীনতার অন্যতম বাহন হলো গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্র, রেডিও এবং টেলিভিশন প্রভৃতি। আর এই গণমাধ্যম সমূহের মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা গণতন্ত্র রক্ষার অন্যতম ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
স্বাধীনতা একটি বিমূর্ত ধারণা। আর বিমূর্ত ধারণার সবচেয়ে বড় গুণ হলো, একে যে যেমনভাবে ব্যবহার করতে চায়, ঠিক তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে বুঝায়, পাঠকের মনের বা চিন্তার স্বাধীনতা, বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা এবং প্রকাশের স্বাধীনতা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় চিন্তার স্বাধীনতা স্বাতন্ত্র্যবোধ ও অধিকারের দ্যোতক। যে সমাজে এই স্বাতন্ত্র্যবোধ ও অধিকার যত অধিক পরিমাণে প্রতিষ্ঠিত, সে সমাজ তত বেশি সুস্থ ও স্থিতিশীল।
আজ থেকে প্রায় সোয়া দুইশত বছর পূর্বে ১৭৬৯ সালে উইলিয়াম ব্ল্যাকস্টোন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জনগণের সামনে প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব অনুভূতি উপস্থাপনের সন্দেহাতীত অধিকার রয়েছে। একে নিষিদ্ধ করা মানে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ধ্বংস করা।
অবশ্য তিনি আরো বলেছেন, যদি তিনি বেঠিক, ক্ষতিকর ও বিধি-বহির্ভূত কোন কথাবার্তা প্রকাশ করেন, তাহলে তার সেই ঔদ্ধত্যের পরিণাম নিজেকেই বহন করতে হবে।
১৮৮৫ সালে এ. ভি. ডিসি বলেছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অর্থ হচ্ছে কোন ব্যক্তির বই অথবা সংবাদপত্রে নিজ ইচ্ছানুযায়ী কোন কিছু প্রকাশের অধিকার।
বাংলাদেশের প্রেস কমিশনের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা হচ্ছে মানুষের অবিচ্ছেদ্য অধিকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতার ধারণাটি বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যে নীতিমালার ওপর মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ধারণাটির উদ্ভব হয়েছে তা সবই এক।
অন্যদিকে, ভারতের প্রথম প্রেস কমিশনের রিপোর্টে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হচ্ছে সরকারি কর্তৃত্বের হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে মুদ্রিত শব্দের মাধ্যমে মতামত জ্ঞাপন এবং তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের স্বাধীনতা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণার ১৯ নম্বর ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেকেরই বাক স্বাধীনতা এবং চিন্তার স্বাধীনতা থাকতে হবে। প্রত্যেকেরই নিজস্ব মত পোষণে কোন বাধা থাকবে না এবং যে কোন সংবাদ গ্রহণ ও বিতরণ করার বিধি নিষেধহীন অধিকার থাকবে।’
সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধ
সংবাদপত্র একটি দেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই একটি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি সহজে অনুধাবন করা যায়। দেশের চলমান বা অতীত বা ভবিষ্যত কৃষ্টি-কালচার, সমাজব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক-অর্থনতিক ব্যবস্থা সম্পর্কে বিভিন্ন চিত্র এবং ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন পরামর্শ সংবাদপত্র ছাড়া আর কে প্রদান করতে পারে?
সংবাদপত্র তার পাঠক সমাজকে তথ্য প্রদান করে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সাথে। সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই সংবাদপত্র এ দায়িত্ব পালন করে আসছে। সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে ‘দ্য টাইমস’ পত্রিকার সম্পাদক ১৮৫২ সালে বলেছিলেন, “সংবাদপত্রের প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে চলমান ঘটনার সবচেয়ে নির্ভূল তথ্য সংগ্রহ করা এবং সেগুলোকে জাতির সাধারণ সম্পদে পরিণত করার জন্য তা জনগণের কাছে দ্রুত প্রকাশ করা।”
সংবাদপত্র যেমন তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য অবাধ স্বাধীনতা দাবি করেন তেমনই একজন সাধারণ নাগরিকেরও সঠিক এবং সত্য তথ্য জানার অধিকার রয়েছে। বস্তুত মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যেই এসে যায় সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধের কথা। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের সংবিধানেও সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
সংবাদ প্রকাশের সকল ক্ষেত্রবিশেষে রিপোর্ট লেখার কিছু কৌশল |
নিউ মিডিয়া আসার ফলে সাংবাদিকতায় কোন ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে? |
নিম্নে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধ আলোচনা করা হলো-
বলা হয়ে থাকে, “Constitution is the basic law and principles of a country.” বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই তাদের নিজস্ব সংবিধান রয়েছে। সেটি লিখিত বা অলিখিত যাই হোক না কেন। এবং এই সংবিধানের আলোকেই প্রতিটি দেশের শাসনব্যবস্থা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, সংবাদপত্রও এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়।
মূলত একারণেই ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়থা দেয়া হয়। ওই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে-
১) চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।
২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃংখলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত অবমাননা, মানহানি বা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ সাপেক্ষে-
ক) প্রত্যেক নাগিরকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং
খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হলো।
বিশ্লেষণ
প্রথম দফা: চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা
এক্ষেত্রে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় দফায় আমরা দেখি বাকস্বাধীনতা ও মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার যে মৌলিক অধিকার প্রদত্ত হয়েছে তা নানাবিধ কারণে যুক্তিসংগত বাধা নিষেধের অধীন। কিন্তু চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা কোন বাধা নিষেধের অধীন নয়। এক্ষেত্রে চিন্তা ও বিবেক সম্বন্ধে রাষ্ট্র কোন প্রকার নিয়ন্ত্রণ করবেন না; প্রয়োজনমত নিয়ন্ত্রণ করবেন চিন্তা ও বিবেকের প্রকাশকে।
দ্বিতীয় দফা:- এক্ষেত্রে সংবিধান নিশ্চয়তা দিয়েছে প্রত্যেক নাগরিকের–
ক) বাক স্বাধীনতার অধিকার
খ) ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এবং
গ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার অধিকার
কিন্তু এই তিনটি স্বাধীনতা আইনের দ্বারা আরোপিত যক্তিসংগত বাধা নিষেধের অধীন। যেমন-
ক) রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে
খ) বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের স্বার্থে
গ) জনশৃংখলার স্বার্থে
ঘ) শালীনতার স্বার্থে
ঙ) নৈতিকতার স্বার্থে
চ) আদালত অবমাননা সম্পর্কে
ছ) মানহানি সম্পর্কে এবং
জ) অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে
ক) বাক স্বাধীনতা
মুক্ত ও অবাধ আলোচনা বাক স্বাধীনতার অন্তর্গত। এবং এই আলোচনার পরিধি ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক প্রভৃতি যাবতীয় বিষয়ে কথা বলবার স্বাধীনতা এই স্বাধীনতার অন্তর্গত।
খ) ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা
ভাব প্রকাশেল স্বাধীনতা বলতে শুধু নিজের ভাব প্রকাশেল স্বাধীনতাকেই বুঝায় না, অন্যের ভাব প্রকাশের স্বাধীনতাকেও বুঝায়।
ভাব প্রকাশের মধ্যে ভাব প্রচারও অন্তর্ভূক্ত। প্রচারিত না হলে ভাব প্রকাশ মূল্যহীন হয়ে পড়ে। রেডিও, সিনেমা, টেলিভিশন, লাউডস্পীকার প্রভৃতিতে ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা এই অধিকারের অন্তর্ভূক্ত।
গ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতা
সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অর্থ লিখার এবং তা প্রকাশ করার স্বাধীনতা। বস্তুত বাক স্বাধীনতা এবং ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা সংবাদক্ষেত্রের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একে নিষিদ্ধ করা মানে স্বাধীনতাকেই নিষিদ্ধ করা। প্রচারের স্বাধীনতা সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার অন্তর্ভূক্ত।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে সংবিধান কর্তৃক আরোপিত বিধি নিষেধগুলো অবশ্যই মেনে চলতে হবে। এক্ষেত্রে কখনোই অতিরিক্ত স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা চালানো যাবে না। কারণ সংবাদপত্রের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারিতা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।