Home » পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ

by TRI

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর আজ পর্যন্ত একাধিকাবার পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে। কখনো অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, কখনো রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকারপ্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ আবার কখনো তাঁদের অযোগ্যতার অভিযোগে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে।

১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম আইয়ুব খাঁন সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। বিচারপতি কাইয়ানি আইয়ুব খাঁনের এ ক্ষমতা দখলকে ‘নিজ দেশ দখলের কৃতিত্ব’ বলে বর্ণনা করেছেন। আইয়ুব খাঁনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর যে হস্তক্ষেপ শুরু হয় তা ধারাবাহিকভাবে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খাঁন, জেনারেল জিয়াউল হক এবং জেনারেল পারভেজ মোশাররফ পর্যন্ত চলে।

আরও পড়ুন:   

 ”বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রবণতা কমছে”- ব্যাখ্যা কর।

নিম্নে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের কারণ সমূহ আলোচনা করা হলো:

১. রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতা

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রধান কারণ হলো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও দুর্বলতা। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলেও একমাত্র জিন্নাহ ব্যতীত অন্য কোনো নেতার নেতৃত্ব তাঁর সমতুল্য হয়নি। জিন্নাহর মৃত্যর পর পাকিস্তানে তেমন কোন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটেনি। ফলে শুরুতেই পাকিস্তান নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে।নেতৃত্বের এ শূন্যতার কারণেই পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটেছে বারবার।

২. নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি

নিম্নমানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের জনগণ বিভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অনুসারী। ভাষাগত বিরোধ, পাঞ্জাবিদের প্রাধান্য ইত্যাদি কারণে পাকিস্তানে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে ওঠেনি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করলেও দীর্ঘ সময়েও সেখানে গণতান্ত্রিক নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেনি। ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোন উৎকর্ষ সাধিত হয়নি। মূলত পাকিস্তানের সংস্কৃতি নিম্ন পর্যায়ের হওয়ায় সেখানে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে বারবার।

৩. সংসদীয় ব্যবস্থার ব্যর্থতা

স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় পর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হয় এবং সে অনুযায়ী সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু এ ধরনের ব্যবস্থাকে অধিক কার্যকর করার মত অনুকূল পরিবেশ তথা রাজনৈতিক দল, সুযোগ্য নেতৃত্ব, পারস্পরিক আস্থা পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল না।

১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট বিজয়ী হলেও সরকার গঠনের অল্পদিনের মধ্যেই এ সরকারের পতন ঘটে। পাকিস্তানের উভয় অংশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং মুসলিম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল দেশে সংসদীয় পদ্ধতির সরকারব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করে। ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে অবিশ্বস্ততা, হানাহানি, বিচ্ছিন্নতাবাদের রাজনীতির প্রকোপ বৃদ্ধি পায়; যা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীকে উৎসাহী করে তোলে।

৪. দায়িত্বশীল বিরোধী দলের অভাব

পাকিস্তানের বিরোধীদলগুলো সর্বদাই ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত। তারা গঠনমূলক বিরোধিতাকে বাদ দিয়ে আন্দোলন সংগ্রামকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে বারবার সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে।

৫. সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব

যেকোন দেশেই রাজনৈতিক শূন্যতা দেখা দিলে তা পূরণে সামরিক বাহিনী এগিয়ে আসে। তৃতীয় বিশ্বের ‍অন্যান্য দেশের ন্যায় পাকিস্তানেও তেমন কোনো শক্তিশালী ও সুগঠিত রাজনৈতিক দল বিকশিত হয়নি। তাছাড়াও সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাবতো ছিলই। রাজনৈতিক অঙ্গনের এ শূন্যতা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে রাজনীতিতে প্রলুব্ধ করেছে।

৬. সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব

পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলব্যবস্থা সুসংগঠিত নয়। এখানে ব্যক্তি স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থের উর্ধ্বে স্থান দেওয়া হয়। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো দলীয় সংকীর্ণতা ও কোন্দলের উর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ফলে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক হস্তক্ষেপের বিপক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করতে পারেনা। যার ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বেড়ে যায়।

৭. ঐকমত্যের অভাব

রাষ্ট্র পরিচালনার ঐকমত্যের অভাব দেখা দিলে স্বাভাবিক কারণেই সেখানে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের ন্যায় পাকিস্তানেরও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি বিধায় সেখানে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ঘটেছে।

৮. রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা

একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিশীলতা সে দেশে নিত্যনৈমিত্তিক রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা পাকিস্তানে বিভিন্ন সময় এমন রূপ ধারণ করে যে, বেসামরিক সরকারের পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় সামরিক বাহিনী পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে এগিয়ে আসে।

৯. ক্ষমতা দখলের ঐতিহ্য

ঐতিহ্যগত দিক দিয়েই পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ক্ষমতালিপ্সু। ১৯৫৮ সালে জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা কর্তৃক সামরিক শাসন জারি ও পরবর্তী সময়ে জেনারেল আইয়ুব খাঁন কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল সে দেশের সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রতি অতি আগ্রহী করে। ১৯৯৯ সালে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ কর্তৃক রাষ্ট্রক্ষমতা দখল তাঁদের অতীত ঐতিহ্যের ফলশ্রুতি।

১০. রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব

পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের একটি অন্যতম কারণ হলো জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব। পাকিস্তানে সুসংগঠিত দলব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সচেতনতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তানে সুসংগঠিত দলব্যবস্থা ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যাপক প্রসার না ঘটায় জনগণ রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। তাছাড়া ক্ষমতাসীনরা কখনো জনগণকে রাজনৈতিক সচেতন হিসেবে গড়ে তোলার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। ফলে জনগণের এ সচেতনতাকে পুঁজি করে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসেছে বারবার।

আরও পড়ুন:   ভারতের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ না হওয়ার কারণসমূহ

পরিশেষে বলা যায় যে, ফৌজি শাসনের জন্য পরিচিত পাকিস্তানের রাজনৈতিক অঙ্গনে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ একটি অতি সাধারণ ঘটনা। দীর্ঘ সামরিক শাসন পাকিস্তানের যেন এক অমোঘ ললাট লিখন। ১৯৪৭ সালে প্রায় একই সাথে ভারত এবং পাকিস্তান স্বাধীনতা অর্জন করে। বর্তমানে ভারত বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, অথচ পাকিস্তানকে সামরিক শাসনের কালিমা এখনো বহন করতে হচ্ছে।

Related Posts