Home » নিউ মিডিয়া আসার ফলে সাংবাদিকতায় কোন ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে?

নিউ মিডিয়া আসার ফলে সাংবাদিকতায় কোন ধরণের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে?

by TRI

নিউ মিডিয়া আসার কারণে সাংবাদিকতায় বিভিন্ন প্রকার পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। এই পরিবর্তনগুলোকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

ক) সাংগঠনিক পরিবর্তন

খ) আধেয়গত পরিবর্তন

গ) দর্শক/পাঠক তথা ভোগের ক্ষেত্রে পরিবর্তন

সাংগঠনিক পরিবর্তনের কারণে সংবাদ প্রযোজনা ও প্রচারের ক্ষেত্রে প্রভাব স্পষ্ট। এখন সংবাদগুলো অনলাইনে তৈরি হয় ও বড় পরিসরে প্রচারিত হয়। আধেয়গত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সংবাদের স্ট্রাকচার পরিবর্তন হয়ে গেছে। সংবাদের উপস্থাপিত বিষয়গুলো আগের গঠন ত্যাগ করেছে। সবশেষ পরিবর্তন ঘটেছে ভোগের ক্ষেত্রে।

নিম্নে নিউ মিডিয়ার প্রভাবে সাংবাদিকতায় সংঘটিত পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

মিডিয়া সংগঠন

নিউ মিডিয়ার আবর্তে বিভিন্ন রকম নতুন যন্ত্রপাতির উদ্ভব ঘটছে প্রতিনিয়ত। এসব নতুন প্রযুক্তির ফলে মিডিয়া সংগঠনের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। মিডিয়া সংগঠনের উপর প্রভাব বলতে মূলত বিভিন্ন সাংগঠনিক রুটিন ও চর্চার পরিবর্তনের কথা বলা যায়। এগুলো ঐ সমস্ত রুটিন, চর্চা বা নিয়ম-নীতি যা সংবাদ উৎপাদনের সাথে যুক্ত। এখন আর নিয়ম-নীতি মেনে সংবাদ উৎপাদন করা হচ্ছে না।

মিডিয়া সংগঠনের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন কর্মকান্ডগুলো মিডিয়ার স্বকীয়তা প্রকাশ করে। এই প্রযুক্তিগুলো সংবাদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করছে। সংবাদ সংগ্রহ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার কাজটিকে বেশ সহজ করে দিয়েছে। তবে অনেক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোন পরিবর্তনটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পরিবর্তনগুলো এসেছে সংবাদের বহুমুখীতার মাধ্যমে। এখানে বহুমুখীতা বলতে এমন একটি প্রক্রিয়ার কথা বলা হয় যা দুটি মিডিয়ার মধ্যেকার দূরত্বকে মুছে দেয়। যেমন- আগে যোগাযোগের বা তথ্য সংগ্রহের মাধ্যম ছিল পোস্ট অফিস ও টেলিফোন। কিন্তু গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমগুলো পরিবর্তিত হয়ে টেলিভিশন, রেডিও ও প্রেসে পরিণত হয়েছে।

আরও পড়ুন:  সমানুভূতি কাকে বলে? সমানুভূতির ক্ষেত্রে বাচনিক ও অবাচনিক দক্ষতাগুলো বর্ণনা কর

বহুমুখীতা

বহুমুখীতার দিক থেকে নিউ মিডিয়া গণমাধ্যম জগতে নতুন জোয়ার এনেছে। বহুমুখীতা শব্দ দ্বারা বুঝানো হয় একই কাজের মাধ্যমে অন্যান্য উদ্দেশ্যসমূহও পূরণ করা। নিউ মিডিয়াতে বহুমুখীতা শব্দটি মূলত তিনটি স্তরে পরিবর্তন এনেছে। যথা- ১) উৎপাদন, ২) বণ্টন ও ৩) ভোগ।

উৎপাদন বলতে সংবাদ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে সংবাদ একটি পণ্য। সংবাদ পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বহুমুখীতা বলতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। এই উন্নয়ন প্রযুক্তিগুলো গণমাধ্যমকে এমন একটি প্ল্যাটফর্মে এনে দাঁড় করেছে যার মাধ্যমে একটি সংবাদকে বিভিন্নভাবে উপস্থাপন করা যায় কোন রকম Re-writing ছাড়া। যেমন- একটি সংবাদ পত্রিকার জন্য লেখা হলেও তা অনলাইনে প্রকাশ করা যায়। আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন পেজেগুলোতেও প্রকাশ করা যায়। এছাড়া বর্তমানে টেলিভিশনেরও সংবাদ পড়তে দেখা যায় যা পত্রিকার জন্য লেখা হয়।

বণ্টনের ক্ষেত্রেও বহুমুখীতার প্রতিফলন আমরা প্রত্যক্ষ করি। এই স্তরে বহুমুখীতা বলতে ঐ ডিভাইস বা যন্ত্রকে নির্দেশ করা হয়েছে যা সকল মিডিয়াকে একসূত্রে যুক্ত করে। যেমন- এইচডি টেলিভিশন, কম্পিউটার ও মোবাইল ফোন।

কম্পিউটারে যেমন টাইপিংসহ সোশ্যাল কম্যুনিকেশন থেকে শুরু করে গেমস খেলা যায়, তেমনি মোবাইল ফোনেও বর্তমানে সব ধরণের কাজ করা যায়। এই স্তরে পূর্বের সংবাদ উপস্থাপনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন প্রযুক্তির অপ্রচলিত রীতিগুলো গ্রহণ করেনা। এই বহুমুখীতার যুগে প্রিন্ট মিডিয়া (সংবাদপত্র, বই মিডিয়া) এর মত পুরনো মাধ্যমগুলো বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। ভবিষ্যতেও একইভাবে নতুন প্রযুক্তির অবদানে বর্তমানের মাধ্যমগুলো বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

ভোগের ক্ষেত্রে বহুমুখীতা পাঠক, দর্শক ও শ্রোতা বাড়ানোর প্রতি বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। এছাড়াও ব্যভহারকারীদের অংশগ্রহণ, তাদের মন্তব্যগুলোও সংবাদ উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। ব্যবহারিকভাবে বহুমুখীতা বিষয়টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানক এমন একটি মাধ্যম খোলার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ করে যার সাহায্যে প্রতিষ্ঠানটি তার পাঠকদের সাথে যোগাযোগ রাখবে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব পাঠকদের প্রত্যক্ষভাবে সংবাদ উৎপাদনে অন্তর্ভূক্ত করে। যেমন- অনলাইন সংবাদ মাধ্যম। এই সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের সাথে সাথে পাঠকদের মন্তব্য করার জন্য নিচে ‘Comment’ বক্স থাকে। পাঠক তার অনুভূতি কিংবা সংবাদের কোন ভূল-ত্রুটি সংশোধনের নিমিত্তে মতামত প্রদান করতে পারে।

মাল্টি-স্কিলিং

এই পরিবর্তনটি সাংবাদিকদের জন্য, যারা সংবাদ প্রস্তুত করে, রেকর্ড করে এবং প্রকাশ করে। নিউ মিডিয়া এসে সাংবাদিকদের দৃষ্টিকোণ পরিবর্তন করে দিয়েছে। এখন একজন সাংবাদিককে একই সময়ে সংবাদ লেখা, সংবাদ সংগ্রহ করা ও বিভিন্ন মাধ্যমের সাহায্যে প্রকাশ করার যোগ্যতা থাকতে হয়। বিভিন্ন মাধ্যম বলতে টেলিভিশন, রেডিও এবং ওয়েব এর কথা বলা যায়।

নিউ মিডিয়া সাংবাদিকদের কাজের ব্যপ্তিকে বড় করে দিয়েছে। একজন সাংবাদিক এখন নিজের সংবাদ রেকর্ড করবেন এবং ফুটেজ ধারণ করবেন, যা সময়ের দাবি। সকল প্রকার প্রযুক্তি সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকবে এবং পরিচালনার যত দক্ষতা অর্জন করবেন। যেমন- অনলাইন সংবাদ মাধ্যমগুলোতে একজন সাংবাদিক নিজেই সংবাদ লেখক, এডিটর, এবং প্রকাশক। মাঝে মাঝে নিজেই ভিডিও এডিটিং ও সম্পাদনার কাজও করেন। তাই বলা যায়, ‘সাংবাদিক বলতে শুধু তথ্য সংগ্রহকারক হবেন’ এই ধারণার দিন শেষ।

আরও পড়ুন:  আগ্রহের ত্রিবলয় – ফিচার লেখার ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়

আধেয়

নিউ মিডিয়া আসার ফলে আধেয়গুলোর ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন প্রযুক্তির ফলে আধেয়গতভাবে ২ প্রকার পরিবর্তনের কথা বলা হয়েছে। যথা-

১) প্রযুক্তিগত পরিবর্তন

নতুন নতুন প্রযুক্তির ফলে সংবাদ উৎপাদন ও প্রকাশের ক্ষেত্রে সময়ের ব্যবধান কমেছে। প্রযুক্তিগত উন্নয়নকে আবার চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা-

ক) Hypertexuality: Hypertexuality বলতে এমন একটি ধারণাকে বুঝায় যার সাহায্যে সংবাদের ডাটাবেজে প্রবেশ করা যায়। ঐ ডাটাবেজে আরো এমন সংবাদগুলো থাকে যা স্ক্রিনে দেখা যাওয়া সংবাদের সাথে সম্পর্কিত। যেমন- আমরা এখন যেসমস্ত সংবাদগুলো অনলাইনে দেখি, সে সংবাদগুলোর শেষে অন্যান্য সংবাদ পড়ার লিংক দেয়া থাকে। উভয় সংবাদই একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে। এই সুবিধাগুলো সংবাদপত্রে পাওয়া যায় না। সংবাদপত্রে মাত্র একটি ঘটনা প্রকাশ করা যায়। আর প্রকাশিত সংবাদের আয়তন সুনির্দিষ্ট। তবে Hypertexuality এর সাহায্যে পাঠক অনেক সংবাদ লিংক এর সাহায্যে পড়তে পারেন।

খ) Multimediality:  সংবাদ বলতে কালো কালিতে লিখা কিছু তথ্য যা মানুষ পড়ে চায়। পুরনো এই ধারণার পরিবর্তন করেছে Multimediality। এখন শুধু তথ্যের সন্নিবেশ হলেই সংবাদ নয়। সংবাদে বর্তমানে তথ্যের সাথে গ্রাফ, ভিডিও কিংবা অডিও যোগ করতে দেখা যায়। একটি সংবাদকে তথ্য-প্রমাণের সাথে আরো বস্তুনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে ভিডিও কিংবা অডিও যোগ করে দেয়া হয়। যেমন- অনলাইন সংবাদগুলোতে ভিডিও কিংবা অডিও যোগ করে সংবাদ দেখা যায়। সংবাদপত্রগুলোতে গ্রাফ ব্যবহার চোখে পড়ে।

গ) Interactivity: সংবাদপত্রের মাধ্যমে শুধুমাত্র একমুখী তথ্য প্রদান করা যায়। এখানে পাঠক feedback দিতে পারে না। তাই বলা হয় পাঠকের সাথে সংবাদপত্রের মিথস্ক্রিয়া হয়না। কিন্তু অনলাইন এর ক্ষেত্রে পাঠকরা কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করতে পারে। পত্রিকাপক্ষ মন্তব্যগুলোর জবাবও দিতে পারছে। মূলত ৫টি বিষয় থাকলে মিথষ্ক্রিয় সফল হয়। তা হলো-

  • পাঠকের পছন্দ করার সুযোগ থাকতে হয়।
  • পাঠকের মন্তব্যগুলোর জবাব দিতে হয়।
  • আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগের সম্পূর্ণ সুযোগ থাকতে হয়।
  • অন্যান্য পোর্টাল থেকে তথ্য শেয়ার করা।
  • সংবাদ উপস্থাপন দ্রুত হতে হয়।

ঘ) Collective Authority: পত্রিকায় সাধারণত রিপোর্টাররা রিপোর্ট লিখেন। সবার পক্ষে সমানভাবে সকল তথ্য জানা সম্ভব নয়। তাই রিপোর্টারদেরও মাঝে মাঝে ভূল তথ্য বা তথ্য ঘাটতি রেখে সংবাদ লিখতে হয়। কিন্তু পত্রিকায় যারা সংবাদ সম্পাদনা করেন, তারা তথ্য ঘাটতি রেখে সংবাদ প্রকাশ করতে পারেন না। তাই অন্যান্য পোর্টাল থেকে সাহায্য নিতে পারেন।

এছাড়াও অনলাইনের যুগে প্রকামিত সংবাদ এডিট করা যায়। একটি সংবাদ প্রকাশের পর যদি নতুন কোন তথ্য পাওয়া যায় তাহলে এডিটিং করে নতুন তথ্যগুলো পুরনো সংবাদ জুড়ে দেয়া যায়।

২) নিউজ নেরেটিভ

জনসম্মুখে সংবাদ প্রকাশের ক্ষেত্রে একটি পদ্ধতি মেনে নিয়মানুসারে সংবাদ লিখে, সকল রীতি-নীতি মেনে নিয়ে প্রকাশ করা হতো। কিন্তু নিউ মিডিয়া আসার ফলে সকল রীতি রেওয়াজ পরিবর্তিত হয়ে যায়। এখন খুব ছোট পরিসরে কিন্তু দ্রুতগতিতে সংবাদ উপস্থাপনের যুগ। সবাই দ্রুততার সাথে পাঠকের নিকট আপডেট পৌঁছাতে চায়। এসবই নিউ মিডিয়ার ফসল।

সংবাদ আগের চাইতে সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। তাই এখন সংবাদের Focal Point কী হতে পারে সে ব্যাপারে জটিলতা তৈরী হচ্ছে। সংবাদ গল্পের মানবিক আবেদন উপস্থাপনের সুযোগে সর্বোচ্চ পাঠকের নিকট পৌঁছানোর মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। পাঠকও সামনে অনেক বেশি অপশন পেয়ে পছন্দমত সংবাদ পোর্টালে ঢুঁ মারছে। এর সবকিছুই নিউ মিডিয়ার কল্যাণে।

অথচ আগেকার দিনে মানুষ সংবাদ পাওয়ার জন্য সকাল থেকে পত্রিকার জন্য অধীর আগ্রতে অপেক্ষা করত। যে সময়গুলোতে সংবাদ প্রচার হয় ঠিক সে সময়ে পাঠক/দর্শক টেলিভিশন, রেডিও এর সামনে বসে থাকতো। এখন নিউ মিডিয়া এর অবদানে পাঠক সমাজের হাতে ক্ষমতা চলে এসেছে।

Related Posts