বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে যে কয়জন মুক্তিসেনানী ও অকুতোভয় বীর পুরুষের নামইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে তাঁদের মধ্যে শহিদ তিতুমীর অন্যতম। তিতুমীর ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমান। সৈয়দ আহমদের বিপ্লবী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিতুমীর চেয়েছিলেন বাঙালি মুসলমানদের জন্য এক নতুন বিশ্ব রচনা করতে। মূলত তিতুমীরের এ বিপ্লবী চেতনার লক্ষ্য ছিল ত্রিবিধ-
১. সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার।
২. শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টা।
৩. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা।
নিম্নে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে তিতুমীরের অবদান আলোচনা করা হলো-
১. সমাজ সংস্কার ও ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার
একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান হিসেবে তিতুমীর সমাজ জীবনে সংস্কার সাধনে ধর্মীয় আলোকবর্তিকা নিয়ে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর আধ্যাত্মিক চেতনার লক্ষ্য ছিল ইসলাম ধর্মকে পুরোপুরিভাবে অনুধাবন করা এবং সমাজ জীবনে এর প্রয়োগ ঘটিয়ে সামাজিক পঙ্কিলতা দূর করা। তিনি বিশ্বাস করতেন মুসলমানদেরকে ধর্মীয় বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করতে না পারলে মুসলমানদের ভিতর দৃঢ় ঐক্য প্রগতিশীল জীবনব্যবস্থা তথা মহান ধারণা পোষণ করতে পারবে না। তাই তিনি সমাজ সংস্কারের মহান ব্রত নিয়ে ইসলাম প্রচারকে জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বেছে নেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর এ ধর্মীয় শিক্ষার পতাকাতলে অগণিত শিষ্য ভিড় জমায়। তিনি শিষ্যদের সুসংগঠিত করে সামরিক শিক্ষা দিতেন।
মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনা কি? মন্ত্রি মিশন পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য সমূহ কি কি? |
২. শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার চেষ্টা
ভারতে ইংরেজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে ইউরোপের ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদ ভারতে নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত তারই চূড়ান্ত রূপ। ফলে ভারতবর্ষের সামন্তপ্রভুদের ও নীল কুঠিয়ালদের ভোগবিলাসের সামগ্রীতে পরিণত হন এ অঞ্চলের নিরীহ গরিব চাষিরা। অত্যাচার আর অবিচারের স্টীম রোলার চলতে থাকে তাদের ওপর। ইংরেজ শাসকগণ divide & rule policy-তে বিশ্বাসী হয়ে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভেদের প্রাচীর গড়ে তোলেন। কৃষ্ণদেব রায় ও কালিপ্রসন্ন’র মতো নিষ্ঠুর জমিদার এ দেশীয় লোক হয়ে কৃষকদের অত্যাচারের কারণ হয়। যার কারণে তিতুমীর অসাম্প্রদায়িক নেতা হয়েও হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে রত হন। এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদমুখর হয়ে প্রজাদেরকে সংঘবদ্ধ করেন। এটি ছিল অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক গণআন্দোলন। এ আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি ছিল চব্বিশ পরগনা ও নদীয়া জেলা। ফলে জমিদাররা তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়ে সেপাই-শাস্ত্রী নিয়ে তাকে আক্রমণ করে। কিন্তু তিতুমীরের অনুপ্রাণিত বাহিনীর সামনে তারা পরাজিত হয়ে পলায়ন করে।
তিতুমীরের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য হিন্দু জমিদার ও ইংরেজ নীলকর বণিকেরা সরকারের নিকট তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তিনি সরকারের নিকট সকল বিষয় ব্যাখ্যা করলেন। কিন্তু সরকার তাঁর কথায় কর্ণপাত না করে তাঁকে দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তখন থেকে তিতুমীরের কর্মপ্রচেষ্টা ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে থাকে। তিনি অনুভব করলেন, দেশ স্বাধীন না হলে জনসাধারণের ভাগ্যোন্নয়ন সম্ভব নয়। যথাশক্তি দিয়ে তিনি ব্রিটিশ শক্তিকে প্রতিহত করতে কৃত সংকল্প হলেন।
৩. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা
তিতুমীর সুস্পষ্টভাবে অনুভব করতে সক্ষম হলেন যে সাধারণ মানুষের উন্নতির জন্য ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রয়োজন স্বাধীনতা অর্জন। পরাধীনতার অন্ধকারে কোনোরূপ কল্যাণমূলক পদক্ষেপ সার্থক হবে না। তাই তিনি ১৮২৫ সালে তাঁর দলবলসহ চব্বিশ পরগনার কিয়দংশ এবং নদীয়া ও ফরিদপুরের কিছু অংশের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হন। অর্থনৈতিক অগ্রসরতার জন্য তিনি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠারও চিন্তা করেন।
বারাসাতের বিদ্রোহ (Revolt of Barasat): চতুর ইংরেজ সরকার তিতুমীরের আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যে কর্ণপাত না করে তাঁকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য হুমকি প্রদান করে। ব্রিটিশ সরকারের এ ধরনের হঠকারিতামূলক ন্যায়নীতিবিহীন সিদ্ধান্ত তিতুমীরকে ভাবিয়ে তোলে। তিনি শক্তি সঞ্চয়ে মনোনিবেশ করেন। অতঃপর ১৮২৫ সালে তিনি তাঁর অনুগত বাহিনী নিয়ে যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন তাকে বারাসাতের বিদ্রোহ বলে। বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে বারাসাতের ম্যাজিট্রেস্ট আলেকজান্ডার বিরাট এক পুলিশ বাহিনী নিয়ে তিতুমীরের বাহিনীর মোকাবিলায় প্রবৃত্ত হন। কিন্তু আলেকজান্ডারের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে। ব্রিটিশ সরকার তখন তিতুমীরকে দমন করার জন্য এক বিরাট সেনাবাহিনী প্রেরণ করে।
বাঁশের কেল্লা (Fort of Bamboo): ‘বারাসাত বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞার আলোকে তিতুমীর বুঝতে পেরেছিলেন আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা সহজসাধ্য নয়। ইংরেজ সরকারকে এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হলে ব্যাপক রণ প্রস্তুতির প্রয়োজন। ১৮৩১ সালে তিনি নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে এক বিপ্লবী কেন্দ্র স্থাপন করেন এবং চতুর্দিকে বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন। হাজার হাজার লোককে সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। স্বাধীনতাকামী ভারতবর্ষের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগণ এখানে বাঁধভাঙা জোয়ারের ন্যায় এসে সংগঠনের কাতারে শরীক হয়। উইলিয়াম হান্টারের মতে, এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৮৩ হাজার। তিতুমীরের অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত এ বিরাট গণবাহিনী ছিল স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ও সংগ্রামী চেতনায় উদ্দীপ্ত।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সমস্যা সমাধানের উপায় সমূহ |
এদিকে ব্রিটিশ সরকার তিতুমীরের এ বিপ্লবী বাঁশের কেল্লার সন্ধান পান। ভারতবর্ষের বড়লাট উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক তিতুমীরকে দমন করার জন্য লে. কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে একদল সুসজ্জিত বাহিনী প্রেরণ করেন। ১৮৩১ সালে স্টুয়ার্টের বাহিনী বাঁশের কেল্লা আক্রমণ করে। আধুনিক মারণাস্ত্রের মুখে তিনিও তাঁর শিষ্যরা আক্রমণ করে বেশি সময় টিকে থাকতে পারেন নি। তিতুমীর এ যুদ্ধে শহিদ হন। অতঃপর তার বিশ্বস্ত অনুচর গোলাম মাসুমসহ অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়। এভাবে জীবন দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠিত করে যান অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের এক মহান ঐতিহ্য।
শহিদ তিতুমীরের অবদান
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে শহিদ তিতুমীরের অবদান অত্যন্ত গৌরবজনক। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তিনিই প্রথম অস্ত্রধারণ করেন। তিতুমীরের বিদ্রোহ আপাতদৃষ্টিতে ব্যর্থ মনে হলেও চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এটা ব্যর্থ ছিল না। তিতুমীরের সংগ্রামী চেতনা ছিল মূলত অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। তাঁর এ চেতনা বাঙালি জাতিকে স্পর্শ করেছে। তিনিই ছিলেন প্রথম বাঙালি মুসলমান যিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রামে আত্মোৎসর্গ করতে কুণ্ঠিত হন নি। তাঁর এ আত্মত্যাগের মহান শিক্ষা বাঙালি জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছে। স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়াসে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার লড়াই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিতুমীরের এ লড়াইকে সামনে নিয়েই স্বাধীনতাকামী বাঙালিরা দুর্ধর্ষ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছে। তিতুমীরের বিদ্রোহই তাই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির সংগ্রামের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত ছিল- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
অতএব উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে শহিদ তিতুমীরের অবদান অনস্বীকার্য।