দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস উপলব্ধি করেন যে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সমস্যা নিরসন না হলে স্বরাজ আন্দোলনের পথে অনিবার্যভাবে বাধা সৃষ্টি হবে। তিনি স্বীকার করেন যে, ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলমান সম্প্রদায়ের ন্যায়সংগত দাবির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শনের অর্থ তাদের প্রতি অবিচার করা। সংখ্যানুপাতিক ধর্মীয় সম্প্রদায়ের জন্য আইন পরিষদে আসন সংখ্যা বণ্টন এবং একই ভিত্তিতে সরকারি চাকরিতে নিয়োগদানের নীতি গ্রহণের প্রশ্নে তিনি দ্বিমত পোষণ করেন নি। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ফর্মুলা বা (Bengal Pact-1923) বেঙ্গল প্যাক্ট বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথ প্রশস্ততর করে। বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদনায় সহযোগিতা করেন আব্দুল করিম। মুজিবর রহমান, আকরম খান, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, স্যার আঃ রহিম, এ. কে. ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়াদীও বেঙ্গল প্যাক্টকে স্বাগত জানান। এ চুক্তির অন্যতম শর্ত ছিল-
ক. মোট সরকারি চাকরিতে ৫৫ ভাগ মুসলমান প্রার্থীকে নিয়োগ করা হবে।
খ. যতদিন এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হবে ততদিন মোট চাকরির ৮০ ভাগ মুসলমান প্রার্থীর জন্য সংরক্ষিত থাকবে। বেঙ্গল প্যাক্টের সমর্থনে চিত্তরঞ্জন দাস আইন পরিষদে বলেন, স্বরাজের বুনিয়াদ রচনার প্রধান পক্ষ মুসলমান। স্বরাজ লাভের পর আমাদের সরকার হিন্দু না মুসলমান এরূপ কোনো সংশয় যাতে আমাদের মনে জাগ্রত না হয় সেজন্য আমরা এ চুক্তিতে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ন্যায়সঙ্গতভাবে প্রাপ্য অংশ নির্ধারণ করেছি। … আমাদের মধ্যে যদি আত্মসম্মানবোধ থাকে তা হলে আমাদের বলা উচিত যে যতদিন না আমাদের অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয় ততদিন আমরা সবকিছু ভাগ করব… আমরা আমাদের অধিকার অর্জন করতে চাই। তা হলো মৌলিক অধিকার। আমি চাই এজন্য হিন্দু-মুসলিম উভয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পারস্পরিক অবিশ্বাস নির্মূল করার জন্য সংগ্রাম করে যাব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিতে তিতুমীরের অবদান |
এ কথা অনস্বীকার্য যে, বেঙ্গল প্যাক্ট হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের সম্ভাবনা উজ্জ্বলতর করেছিল। চিত্তরঞ্জন দাস এ চুক্তিকে সংগত কারণেই হিন্দু-মুসলিম ফেডারেশনের সাংবিধানিক দলিল বলে উল্লেখ করেন। তিনি অসাম্প্রদায়িক উদার মনোভাব নিয়ে বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদন করেছিলেন। কিন্তু হিন্দু মহাসভার নেতৃবর্গের প্রবল বিরোধিতার কারণে তাঁর মহৎ উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে যায়।
তবে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তোষামুদে ছিলেন না। তিনি ছিলেন যথার্থই খাঁটি দেশপ্রেমিক। তিনি বলেন, “I find in the conception of my country the expression of divinity.” সুতরাং স্বরাজ অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারেও দ্বিধান্বিত হননি। স্বরাজ অর্জনের জন্য যে পথ তিনি অনুসরণ করেন সে সম্পর্কে অনেকের দ্বিমত ছিল সত্য কিন্তু একজন খ্যাতিমান আইনজীবীর পক্ষে নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করাই ছিল স্বাভাবিক। প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ যদি দেশবন্ধুর মতো উদার মনোভাব নিয়ে হিন্দু-মুসলিম সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতেন তা হলে হয়তো উপমহাদেশের রাজনীতির ধারা সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতো। আর হয়নি বলেই উভয় সম্প্রদায়ের ব্যবধান ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে, তীব্রতর হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংঘাত।