গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা
রাজনৈতিক দল আধুনিক শাসনব্যবস্থার অপরিহার্য উপাদান। অ্যালান আর বল এর মতে- ‘রাজনৈতিক দল ছাড়া আধুনিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কল্পনা করা কঠিন’। (It is difficult to imagine modern political system without Political Parties.) আধুনিক বৃহদায়তন রাষ্ট্রে বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা অসম্ভব। তাই জনগণ প্রতিনিধি নির্বাচন করে তাদের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। আধুনিক প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হলো রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা তথা গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা অসামান্য। নিম্নে গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা বা গুরুত্ব আলোচনা করা হলো-
১ . গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুদৃঢ়করণ
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে সুদৃঢ়করণে রাজনৈতিক দলের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রের সফলতা রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা ছাড়া অকল্পনীয়। অধ্যাপক ফাইনারের মতে, ‘Democracy rests in its hopes and doubts upon the party system. There lies political centre of gravity’ |
রাজনৈতিক দল কত প্রকার ও কি কি? – বিস্তারিত আলোচনা |
২. রাজনৈতিক সামাজিকীকরণ
গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হিসেবে সুনাগরিকের কথা বলা হয়। কিন্তু নির্লিপ্ততা, স্বার্থপরতা প্রভৃতি সুনাগরিকতার পথে বড় বাঁধা হিসেবে দেখা দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো সভা-সমিতি, বক্তৃতা, আলাপ-আলোচনা, দলীয় মিছিল, প্রচারকার্য প্রভৃতি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের দ্বারা জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞানের বিস্তার ঘটায় এবং রাজনৈতিকভাবে জনগণকে সচেতন করে তোলে। এভাবে জনগণের নির্লিপ্ততা দূর হয় এবং দেশ ও দেশবাসীর ব্যাপারে দায়িত্ববোধের সৃষ্টি হয়।
৩. সরকারের সফলতা
আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল সরকারের সফলতা অর্জনে ভূমিকা রাখে। বস্তুত আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হচ্ছে দলীয় শাসনব্যবস্থা। সুতরাং রাজনৈতিক দল দায়িত্বশীলতার সাথে কাজ করলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও স্বীকৃতি বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডের ওপরই সরকারের সফলতা নির্ভর করে।
৪. সুশাসন প্রতিষ্ঠা
সুশাসন প্রতিষ্ঠায় রাজনৈতিক দল সক্রিয় ভূমিকা রাখে। বিশ্বের বহু রাষ্ট্রে এখনও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এর মূলে রয়েছে অসংগঠিত রাজনৈতিক দল। রাষ্ট্র পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অর্জনের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলের ভূমিকাই মুখ্য। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল সুষ্ঠু নির্বাচন, জনগণের অধিকার রক্ষা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশ্বাসী। আর এগুলো সুশাসন প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য উপাদান।
৫. জাতীয়তাবাদী আন্দোলন
বর্তমানে গণতান্ত্রিক দলগুলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। বস্তুত জনগণের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনার প্রসার ঘটিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে। উদাহরণ হিসেবে ভারতীয় কংগ্রেস এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নাম উল্লেখ করা যায়।
৬. শান্তিপূর্ণ ও সাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতার পালাবদল
শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতার হস্তান্তর রাজনৈতিক দলের একটি পবিত্র দায়িত্ব। রাজনৈতিক দল শান্তিপূর্ণভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে ক্ষমতা পরিবর্তনে সহায়তা করে। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দল সাংবিধানিক পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে জনসমর্থন লাভ করে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। এক্ষেত্রে কোনো বিপ্লব বা বিদ্রোহের প্রয়োজন হয় না।
৭. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা রাজনৈতিক দলের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে সংহতি রক্ষায় সচেষ্ট। সহযোগিতা ও সহনশীলতার মাধ্যমে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে রাজনৈতিক দলগুলো সক্রিয় ভূমিকা রাখে। তাছাড়া রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সহাবস্থান নীতি মেনে চলে। আর সহাবস্থান নীতি মেনে চলার ফলে রাষ্ট্রে স্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে।
৮. রাজনৈতিক যোগাযোগ
রাজনৈতিক দল রাজনৈতিকভাবে নাগরিকদের সংঘবদ্ধ করে থাকে। গণতান্ত্রিক দলসমূহ জনসমাবেশ, বিক্ষোভ, মিছিল প্রভৃতির মাধ্যমে জনসাধারণকে সংঘবদ্ধ করে। অপরদিকে ফ্যাসিস্ট দলসমূহ সভা- সমিতি, জমায়েত, পতাকা, ইউনিফর্ম প্রভৃতির মাধ্যমে দল ও জনসাধারণের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন তৈরি করে রাজনৈতিক সংঘবদ্ধকরণ করে থাকে।
রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য গুলো কি কি? |
৯. স্বার্থের একত্রীকরণ
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় বিভিন্ন প্রকার স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে নিজেদের দাবি সরকারের নিকট তুলে ধরে। এভাবে রাজনৈতিক দল স্বার্থের একত্রীকরণ করতে সাহায্য করে।
১০. অর্থনৈতিক কার্যাবলি
দলীয় কার্যাবলি প্রচারের জন্য অর্থের প্রয়োজন। দল বিভিন্ন উৎস থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে তহবিল গঠন করে। দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিয়মিত চাঁদা আদায় করা হয়। আবার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে বিত্তহীন প্রার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়।
পরিশেষে বলা যায়, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলের ভূমিকা ও গুরুত্ব ব্যাপক ও বহুমুখী। আর রাজনৈতিক দলের তৎপরতায় গণতন্ত্র প্রকৃত অর্থে জনগণের শাসনে পরিণত হয়।