মানবাধিকারের অন্তর্নিহিত বিষয় হচ্ছে ’মানুষ’ ও ‘অধিকার’। শব্দ দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত। সহজভাবে ’মানবাধিকার’ বলতে আমরা সেই সব অধিকারকে বুঝি যা নিয়ে মানুষ জন্মগ্রহণ করে এবং যা তাকে পরিপূর্ণ মানুষে বিকশিত করতে সাহায্য করে এবং যা হরণ করলে মানুষ আর মানুষ থাকেনা। মানুষ হিসেবে জন্মেছে বলেই এসব অধিকারও তার প্রাপ্য হয়েছে। মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উঠতে দরকার মানবাধিকার। মানবাধিকার ছাড়া মানুষের পূর্ণতা আসে না, মানুষ পরিপূর্ণরূপে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না। মানুষের জীবন-মৃত্যু যেমন মানুষ থেকে অবিচ্ছেদ্য তেমনি তার জন্যে কতিপয় মৌলিক অধিকারও অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য। আজ বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের চেতনা জাগ্রত হচ্ছে; মানুষ আরও বেশি সক্রিয় হচ্ছে মানবাধিকার রক্ষায়। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী ও রাষ্ট্র মানবাধিকারের বিষয়ে এখন সদা জাগ্রত। তাই যখন মানবাধিকার লঙ্গিত হয় তখন বিশ্ব বিবেক এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে। ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, গবেষক, বিচারক, সরকার তথা সর্বস্তরের মানুষের জন্যই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
মানবাধিকার কি?
“মানবাধিকার” শব্দটিকে আরো সহজ করে বললে বলতে হবে “মানবের অধিকার” বা মানুষের অধিকার। অতএব, মানুষ এবং অধিকার শব্দদ্বয় হচ্ছে মানবাধিকারের অন্তর্নিহিত বিষয়। শব্দ দু’টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যমন্ডিত। মানবাধিকার বলতে সেই অধিকার বোঝায় যা নিয়ে মানুষ জন্মায় এবং যা তাকে বিশিষ্টতা দেয় এবং যা হরণ করলে সে আর মানুষ থাকে না। মানুষ জন্মসূত্রেই চিন্তাশক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা এবং কথা বলার যোগ্যতা নিয়ে আসে। কোন রাষ্ট্র, সরকার বা স্বার্বভৌম শক্তি তাকে এসব প্রদান করে না। মানুষের জীবনটাও কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের দান নয়। অতএব রাষ্ট্র, সরকার বা অন্য কোন শক্তি মানুষের এসকল অধিকার কেড়ে নেয় তাহলে প্রকারান্তরে সে তার মনুষ্যত্বই কেড়ে নিল, হরণ করল তার মানবিক বৈশিষ্ট্য। এ অধিকারগুলো মানুষের অবিচ্ছেদ্য এবং অন্তর্নিহিত। এ সকল অধিকার থেকে মানুষকে পৃথক করার কোন উপায় নেই। অতএব মানবাধিকার বলতে সেই অধিকার বুঝায় যে অধিকার নিয়ে মানুষ জন্মায় এবং যে অধিকার অর্জিত হলে মানুষ পূর্ণভাবে বিকশিত হতে পারে। সৃষ্টির সেরা মানুষ, আর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের শিখরে উঠতে দরকার মানবাধিকার। মানবাধিকার ছাড়া মানুষের পূর্ণতা আসে না, মানুষ পরিপূর্ণরূপে মানুষ হয়ে উঠতে পারে না।
মানবাধিকার ধারণার বিকাশ
মানবাধিকারের অভিব্যক্তিটি তুলনামূলকভাবে নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর এ অভিব্যক্তিটি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ইউরোপীয় পুনর্জাগরণ তথা রেঁনেসার যুগ থেকেই মানবাধিকারের ধারণাটি মানব মনে দানা বাঁধতে শুরু করে। রেঁনেসা ও গণতন্ত্রের দ্বারা সমৃদ্ধ দার্শনিকগণই সর্বপ্রথম রাজশক্তি এবং ধর্মীয় শক্তির তথা উপাসনালয়ের একচ্চত্র প্রাধান্যের পরিবর্তে মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলতে শুরু করে। ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইট ইত্যাদি মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাকে আইনগত স্বীকৃতি প্রদান করে। এসকল দলিলেরও মূল কথা হচ্ছে, মানুষ এমন কিছু অধিকার নিয়ে জন্মায় যেগুলো অবিচ্ছেদ্য এবং যেগুলো কখনো পরিত্যাজ্য নয়। যেগুলো কেউ হরণ করতে পারে না।
আরও পড়ুন: আইনের উৎস কয়টি ও কী কী? মানুষ আইন মান্য করে কেন?
সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতাব্দীতে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মানুষের অভূতপূর্ব অগ্রগতি গোটা মানবসমাজকে এক অভূতপূর্ব আলোকিত যুগে নিয়ে আসে। সপ্তদশ শতাব্দীর ইংরেজ দার্শনিক লক অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক মন্টেস্কু, ভলতেয়ার, রুশো প্রমুখের লেখায় একথা জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয় যে, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেই মানুষ যে সকল অধিকার স্বভাবতই অর্জন করছে রাষ্ট্র সেগুলো কেড়ে নিতে পারে না। তাদের মতে, জীবনের অধিকার, স্বৈরাচারি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার ইত্যাদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগেও ছিল। Social Contract বা সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এবং রাষ্ট্রকে নির্দেশ দেয় এইসকল অধিকার রূপায়নের। সুতরাং বলা যায় যে, মানুষ রাষ্ট্রের কাছে তাদের অধিকারগুলো সমর্পণ করেনি বরং সেগুলো আমানত রেখেছে মাত্র। তারা বলেন, রাষ্ট্র কখনো মানুষের স্বভাবজাত অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কারণ মানুষ জন্মেছে বিবেক আর যুক্তি নিয়ে এবং যা কিছু যুক্তি ও বিবেকের বিরুদ্ধে তা মানবতারই বিরুদ্ধে। বস্তুত স্বৈরাচারী রাষ্ট্রতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবতার যে আহ্বান তাই হচ্ছে মানবাধিকারের ভিত্তি।
ক্রমেই মানবাধিকারের ধারণা দৃঢ়তা লাভ করে। দাসত্বের এবং দাস ব্যবসার মতো অমানবিক প্রথা নিষিদ্ধ হয়, কারখানা আইন প্রবর্তনের মাধ্যমে শ্রমিকের মজুরি এবং কাজের সময়সীমা নির্ধারিত হয়, ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে, সার্বজনীন ভোটাধিকারের নীতি গৃহীত হয়। এসবই মানুষের স্বভাবজাত অধিকার তথা মানবাধিকারের দাবির পরিণতি।
মানবাধিকারের পরিধি ও তাৎপর্য
মানবাধিকার বলতে কি বুঝায়, এর পরিধি কতটুকু বিস্তৃত তা যদি আমরা পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাব যে, প্রথমত, মানবাধিকার এমন কিছু অধিকারকে নির্দেশ করে যা শুধু মানুষের, পশুপাখি বা গাছপালার নয়। দ্বিতীয়ত, মানবাধিকার হচ্ছে সকলের অধিকার, কোন শ্রেণী বা দলের নয়। তৃতীয়ত, মানবাধিকার সকল মানুষের সমানভাবে প্রাপ্য, কারো কম বা কারো বেশি নয়। চতুর্থত, মানবাধিকার কোন বিশেষ মর্যাদা বা সম্পর্কের উপর নির্ভরশীর নয়। পঞ্চমত, মানবাধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যা আদায়যোগ্য। ষষ্ঠত, মানবাধিকার সমগ্র বিশ্বের সর্বস্থানে, সর্বকালের সকল মানুষের প্রাপ্য। সপ্তমত, মানবাধিকার কেউ কাউকে দেয় না এবং এর প্রাপ্তি কারো কৃপার উপর নির্ভরশীল নয়; মানুষ যেহেতু মানুষ সেহেতু সে এসকল অধিকার লাভ করে।
মানবাধিকার মানুষের অধিকার
যে অধিকার একান্তভাবেই মানুষের, প্রথমত, তাকেই মানবাধিকার বলে। পশুপাখির প্রাণ আছে তাই তারা প্রাণী, মানুষের প্রাণ আছে, তাই মানুষও প্রাণী। প্রাণীর এই দুই শ্রেণীর মধ্যে নিশ্চয়ই তফাৎ আছে। পশুপাখি যা পারে না মানুষ তা পারে। মানুষের এই বিশেষ ক্ষমতাই তার বিশেষ অধিকার। মানুষ চিন্তা করতে পারে, উদ্ভাবন করতে পারে। চিন্তা ও উদ্ভাবনের এই ক্ষমতা মানুষকে পশুপাখি থেকে পৃথক করেছে। এই শক্তি বা ক্ষমতা নিয়েই মানুষ জন্মেছে। এ শক্তির ব্যবহারের অধিকারই মানবাধিকার। অকারণে এ অধিকার খর্ব করা যায় না। খর্ব করলে বা নষ্ট করলে তাকে মানবাধিকারের উপর হস্তক্ষেপ বলে মনে হয়। কোন সমাজপতি, রাষ্ট্রপতি বা ধর্মপতি যদি মনে করেন উচ্চতর মেধা ও প্রতিভার কারণে তারাই শুধু চিন্তা ও উদ্ভাবনী শক্তির ধারক হতে পারেন তাহলে মানবাধিকারের দৃষ্টিতে সেটা অন্যায় দাবি বলে বিবেচিত হতে হবে। মানবাধিকারের প্রবক্তাগণ বলেন, মানুষের এসকল অধিকারের ক্ষেত্রে তাঁকে বাঁধাহীন হতে হবে। এসকল ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা থাকতে হবে। চিন্তা, ভাবপ্রকাশ, চলাফেরা, কথা বলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মানুষের স্বাধীনতা থাকার অধিকারই মানবাধিকার। অকারণে এসকল ক্ষেত্রে বাধা প্রদান করা মানবাধিকারের পরিপন্থি।
মানবাধিকার সকল মানুষের অধিকার
মানবাধিকার হচ্ছে সকল মানুষের অধিকার। এ অধিকার কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী, শ্রেণী বা দেশের অধিকার নয়। সকল মানুষ অভিন্ন নয়, বরং প্রত্যেক মানুষই স্বতন্ত্র, কিন্তু জীবনের বৃহৎ এলাকায় সকল মানুষ অভিন্ন, এক। এই অভিন্ন এলাকায় যেকোন ধরনের বৈষম্য মানবাধিকারের পরিপন্থি।
মানবাধিকার সকলের সমান প্রাপ্য
মানবাধিকারের ধারণা মধ্যে আছে সকল মানুষের সমান অংশ। মানবাধিকার যেমন সকল মানুষের অধিকার তেমনি এ অধিকার সকলের সমান ভাবে প্রাপ্য। রাজা-বাদশা, গুরু-পুরোহিত, শিল্পপতি প্রমুখের অধিকার যতটুকু সাধারণ চাষী, মজুর, দরিদ্র বেকারেরও ঠিক ততটুকুই অধিকার। চুরি করলে জমিদার তনয়া শুধু ধমক খেয়ে ছাড়া পাবে আর দরিদ্র চাষীর মেয়ের হাত কাটা যাবে, জেল হবে এমন অবস্থা মানবাধিকারের পরিপন্থি।
মানবাধিকার বিশেষ মর্যাদা নির্ভর নয়
বিশেষ মর্যাদার কারণে মানবাধিকারের ঘোষণা মানুষের মধ্যে পার্থক্য করে না। জীবন ধারণের অধিকার, জীবনভোগের অধিকার, আহারের অধিকার, বিশ্রামের অধিকার, আশ্রয়ের অধিকার, নিরাপত্তার অধিকার, বিচারের অধিকার, ভাবপ্রকাশের অধিকার, চলাফেরার অধিকার, সমাবেশের অধিকার- এসকল অধিকার মানুষ মাত্রেই প্রাপ্য। বিশেষ মর্যাদার কারণে এসকল অধিকারের উদ্ভব হয় না।
মানবাধিকার আদায়যোগ্য
মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণায় বর্ণিত অধিকারসমূহ হচ্ছে এমন যেগুলো আদায়যোগ্য। মানবাধিকার হচ্ছে এমন অধিকার যেগুলো বিমূর্ত এবং অবাস্তব কিছু নয়। মানুষের বাস্তব জীবনের সাথে এসকল অধিকারের যোগ, মানবজীবন থেকে এসবকে বিচ্ছিন্ন করার কোন উপায় নেই। মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে, মানুষের মতো বেঁচে থাকতে হলে এসকল অধিকার আদায় করতেই হবে এবং এগুলো আদায়ের অযোগ্য বা অসম্ভব কিছু নয়।
মানবাধিকার সার্বজনীন
সকল স্থান, কাল, পাত্রভেদে যে সকল অধিকারে তারতম্য হয় না সে সকল অধিকারেই মানবাধিকার। সময়ের চাকা ঘুরতে থাকবে, সভ্যতার বিকাশ হবে, চলতে থাকবে মানব জীবন, সমাজ পরিবর্তন হবে, ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে মানুষের জীবন জীবিকার পার্থক্য হবে কিন্তু পরিবর্তন হবে না মানবাধিকার। মানবাধিকার হচ্ছে এমন কতকগুলো অধিকার যেগুলো সকল স্থানের, সকল সময়ের সকল মানুষের। আর সেজন্যই এ অধিকারগুলোকে বলা হয় সার্বজনীন। এ অধিকারগুলো চিরন্তন। ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, অঞ্চল ইত্যাদির নিরিখে মানবাধিকার বিভক্ত করার কোন উপায় নেই।