গণতন্ত্র কি ?
গণতন্ত্রের অর্থ হচ্ছে জনগণের শাসন। অতীত ও মধ্যযুগে গণতন্ত্র মূলত এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক যুগে গণতন্ত্র বলতে আমরা কেবল এক ধরনের সরকারকেই বুঝিনা, সাথে সাথে এক ধরনের সমাজ ব্যবস্থাকেও বুঝি। এ ধরনের সমাজব্যবস্থা যেখানে বিরাজমান নেই, সেখানে শাসনপ্রথা গণতন্ত্র নামে পরিচিতি হলেও তা সম্পূর্ণরূপে গণতান্ত্রিক নয়। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্র বলতে আমরা এক প্রকার শাসন ব্যবস্থাকে বুঝি।
প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে গ্রীক ঐতিহাসিক হিরোডোটাস (Herodotus) গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে বলেছেন, “গণতন্ত্র এক প্রকার শাসনব্যবস্থা যেখানে শাসন ক্ষমতা কোন শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহের উপর ন্যস্ত থাকে না, বরং সমাজের সদস্যগণের উপর ন্যস্ত হয় ব্যাপকভাবে।”
আরও পড়ুন: জীবন বীমা কি ? জীবন বীমা কেন করবেন ? বৈশিষ্ট্য এবং অন্যান্য
এর প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই আধুনিককালের শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ লর্ড ব্রাইসের সংজ্ঞায়। গণতন্ত্র সম্পর্কে লর্ড ব্রাইস বলেন, “যে শাসন প্রথায় জনসমষ্টির অন্তত তিন-চতুর্থাংশ নাগরিকের অধিকাংশের মতে শাসনকার্য পরিচালিত হয়, তাই গণতন্ত্র।
এক্ষেত্রে এটাও উল্লেখযোগ্য যে নাগরিকদের ভোটের শক্তি যেন তাদের শারীরিক বলের সমান হয়” (A government in which the will of the majority of the qualified citizens rules …. Say, at least three-fourths so that the physical force of the citizens coincides with their voting power”).
লর্ড ব্রাইস এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ঐ শাসনব্যবস্থাই গণতান্ত্রিক, যা (ক) জনসাধারণের ইচ্ছা, (খ) তাদের মঙ্গলামঙ্গল ও (গ) হিতকর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং (ঘ) যেখানে সাম্য ও স্বাধীনতা প্রাধান্য পায়। বিয়াট্রীস ওয়েব (Beatrice Webb) ও সিডনি ওয়েব (Sidney Webb) আর এক ধাপ অগ্রসর হয়ে বলেছেন, “কোন নির্দিষ্ট এলাকায় সকল প্রাপ্তবয়স্ক অধিবাসীদের সংঘ যখন রাজনৈতিক আত্মশাসনের ক্ষমতা ও অধিকার ভোগ করে তখন তাকে রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলা হয়।”
স্যার ক্রিপস বলেন, ”গণতন্ত্র বলতে আমরা সেই শাসনব্যবস্থাকে বুঝি, যেখানে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি সকল বিষয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে এবং সকলের মধ্যে নিজ নিজ মত প্রকাশ করতে পারে।”
ম্যাকইভারের মতে, “গণতান্ত্রিক শাসনে সরকার জনগণের এজেন্ট মাত্র এবং সেই হিসেবে তারা সরকারকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করে।”
তবে গণতন্ত্র সম্পর্কে সি এফ স্ট্রং (C F Strong) –এর সংজ্ঞা অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি বলেন, “শাসিতগণের সক্রিয় সম্মতির উপর যে সরকার প্রতিষ্ঠিত তাকে গণতন্ত্র বলা যায়” (“Democracy implies that government which shall rest on active consent of the governed”) ।
কিন্তু, গণতন্ত্র সম্পর্কে মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞাই সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়, যদিও তা অধিকতর অস্পষ্ট। তাঁর মতে, “গণতন্ত্র হল, জনসাধারণের দ্বারা, জনসাধারণের কল্যাণের জন্যে পরিচালিত ও জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা” (“Government of the people, by the people and for the people”) । প্রেসিডেন্ট লিংকন আর ও বলেন, “জনসাধারণের সম্মতি ছাড়া তাদেরকে শাসন করবার অধিকার কারো নেই”। (“No man has a right to govern without other man’s constant”) ।
অনেকে আবার গণতন্ত্রকে একাধারে শাসনব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা হিসেবেও বর্ণনা করেন। গণতন্ত্র বলতে অনেকে আবার অর্থনৈতিক সাম্যের কথাও বলেন। শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র বলতে এটাই বুঝায় যে রাষ্ট্রের সকল শ্রেণীর মানুষ সমভাবে সরকারের প্রতিনিধিত্ব করে, আইন পরিষদে সকল শ্রেণীর মতামত প্রতিফলিত হয় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয় নিয়মিত নির্বাচন প্রতিযোগিতায়, রাজনৈতিক কার্যাবলীতে সকলের অংশগ্রহণের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্যক্তি স্বাধীনতার ভিত্তিতে গড়ে উঠা শাসনব্যবস্থাই রাজনৈতিক গণতন্ত্র বলা যায়।
অন্যদিকে সমাজব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র বলতে আমরা সেরূপ সামাজিক পরিবেশকে বুঝি যেখানে তীব্র অসাম্য অনুপস্থিত এবং সমতার ভিত্তিতে সকলে জনকল্যাণকর কার্যাবলীতে অংশগ্রহণ করে এবং সকলে সমাজের অপরিহার্য অংশ হিসেবে সুখ-সুবিধার অংশীদার হয়।
আবার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসেবে গণতন্ত্র সকলকে সমান সুযোগ দান করে, কাজ করবার অধিকার হতে কেউ বঞ্চিত নয় এবং সর্বোপরি সকলের সর্বনিম্ন প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাব বোধ না হয়। অনেকের মতে, এই তিন ব্যবস্থা সু-সমন্বিত হলেই কেবল অকৃত্রিম ও অনাবিল গণতন্ত্র সম্ভব।
গণতন্ত্রের প্রকারভেদ
গণতন্ত্রকে নিম্নোক্ত দু’ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়। যথা-
প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র
আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে যে সরকার বা শাসনব্যবস্থা গঠন করা হয় তা হচ্ছে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র বলতে বোঝায় এমন এক সরকারকে যেখানে দেশের সকল নাগরিক সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণপূর্বক শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে। বর্তমানে রাষ্ট্রের পরিধি ও জনসংখ্যার আকৃতি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বেশ জটিল ও কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই বর্তমানকালে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পৃথিবীর খুব একটা বেশি দেশে দেখা যায় না। তবে সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি প্রদেশে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রচলিত রয়েছে।
পরোক্ষ গণতন্ত্র
যে গণতন্ত্রে পরোক্ষভাবে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ সরকার নির্বাচন করে তাকে পরোক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা হয়। অর্থাৎ পরোক্ষ গণতন্ত্র বলতে বোঝায় সেই ধরনের শাসনব্যবস্থা যেখানে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিগণ শাসনকার্য পরিচালনা করে। প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয় বিধায় এর অপর নাম প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র। এ জাতীয় শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন না করে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিনিধি নির্বাচন করে পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে। এ জন্যেই একে পরোক্ষ গণতন্ত্র বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি রাষ্ট্রে এ ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে।
গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহ
গণতন্ত্রের কতকগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। কোন শাসনব্যবস্থা গণতান্ত্রিক কিনা তা এসব বৈশিষ্ট্যের মানদন্ডে বিচার করে সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি।
প্রথমত, লক্ষ্য করতে হবে উক্ত শাসনব্যবস্থায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয় কিনা;
দ্বিতীয়ত, নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারকে পরিবর্তন করা যায় কিনা;
তৃতীয়ত, উক্ত ব্যবস্থায় দল গঠন, মত প্রকাশ ও সমালোচনার অধিকার স্বীকৃত হয়েছে কিনা;
চতুর্থত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের স্বার্থরক্ষার সুবন্দোবস্ত রয়েছে কিনা;
পঞ্চমত,উক্ত ব্যবস্থায় প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিত্ব বিকাশের উপযোগী রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকারসমূহ আইনগতভাবে সংরক্ষণের ব্যবস্থা আছে কিনা; এবং
শেষত, জনসাধারণ এ আশ্বাস পেয়েছে কিনা যে, সুষ্ঠু বিচার ছাড়া তাদের অহেতুক বন্দীদশা ভোগ করতে হবে না, অথবা অন্য কোন শাস্তি ভোগ করতে হবে না। উল্লেখিত ব্যবস্থাসমূহের উপস্থিতি যে কোন ব্যবস্থাকে গণতান্ত্রিক করতে সমর্থ।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ সলটু বলেন, গণতন্ত্রের মধ্যে চার সত্য অনুধাবনযোগ্য।
প্রথমত, গণতন্ত্রে প্রত্যেকের স্বাধীন মতামত প্রকাশের জন্মগত অধিকার স্বীকার করা হয়;
দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্রের রাষ্ট্রকে কোন অভ্রান্ত সত্যের প্রতীক বলে গ্রহণ করা হয় না;
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক অধিকারে ক্ষেত্রে ও আইনের চোখে সবাই সমান;
চতুর্থত,গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সকলের মতামতের দ্বারা অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে। এ চারটি উপাদানের সুসমন্বয়ে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তা গণতান্ত্রিক।
সুতরাং গণতন্ত্রে মৌলিক কথা হচ্ছে- শাসন সংক্রান্ত ব্যাপারে শাসিতদের সম্মতি লাভ।