স্বাধীনতা ও সাম্যের সম্পর্ক
স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। বস্তুত সাম্য ছাড়া যেমন স্বাধীনতা হয় না, তেমনি স্বাধীনতা ছাড়া সাম্যও অসম্পূর্ণ থেকে যায়। বৃহৎ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলে স্বাধীনতা ও সাম্যকে একই রূপ মনে করা হয়। মূলত স্বাধীনতা ও সাম্য হলো একই মুদ্রার বিপরীত দিক। ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় সাম্যের দাবির বহু আগে স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি ওঠে। প্রাচীন গ্রিসে এবং রোমে যখন দাসব্যবস্থার প্রচলন ছিল তখন সব মানুষকে সমান ভাবা হতো না। সে সময় সাম্যের চেয়ে স্বাধীনতার স্থান ছিল অনেক উপরে। দাসপ্রথার বিধিবদ্ধতাকে অগ্রাহ্য করে স্টোয়িক (অবিচলবাদী) চিন্তাবিদরা প্রাকৃতিক সাম্যের ধারণা প্রচার করলেও সমকালীন গ্রিক সমাজে তা গ্রাহ্য হয়নি। মধ্যযুগ পর্যন্ত সাম্যের আদর্শ উপেক্ষিত ছিল। সাম্য ও স্বাধীনতার আদর্শের সমন্বয়ের বিষয়টি সর্বপ্রথম আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে (১৭৭৬) এবং পরে ফরাসি বিপ্লবের ঘোষণায় (১৭৮৯) বাস্তব রূপ লাভ করে।
আরও দেখুন: স্বাধীনতা কি | স্বাধীনতার সংজ্ঞা দাও
স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বর্তমানে দুটি পরস্পরবিরোধী মতবাদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। যথা-
ক. স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরবিরোধী।
খ. স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক।
ক. স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরবিরোধী
স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পরবিরোধী। একটির আবির্ভাব ঘটলে অপরটির তিরোধান ঘটে। ফরাসি রাষ্ট্র দার্শনিক ডি টকভিল (De Tocquevile) এবং ইংরেজ রাষ্ট্র দার্শনিক লর্ড অ্যাক্টন (Lord Acton) এ ধারণার সমর্থক। তাদের মতে, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই সাম্য নীতির প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হয়। ফলে সরকারের কার্যাবলি হ্রাস পায়।’ কিন্তু এ মতবাদ নিতান্তই ভ্রান্ত। কারণ স্বাধীনতার অর্থ নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা নয়। নিয়ন্ত্রণহীন স্বাধীনতা স্বেচ্ছাচারিতার সামিল।
খ. স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক
স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর সম্পূরক অর্থাৎ এরা পরস্পর বিরোধী নয়। একে অপরের পথে কোনো বাধা-বিপত্তি সৃষ্টি করে না। সাম্যের অস্তিত্ব ছাড়া স্বাধীনতার উপলব্ধি অসম্ভব। স্বাধীনতার আদর্শকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্যে সাম্যের পরিবেশ প্রয়োজন। মানবভার নিরবচ্ছিন্ন সম্প্রসারণ যদি স্বাধীন হয় তাহলে সাম্যভিত্তিক সমাজ ছাড়া এ স্বাধীনতা অসম্ভব। রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সৃষ্টি ও সংরক্ষণ করে। আবার রাষ্ট্র স্বাধীনতা সংরক্ষণের স্বার্থে আইনের মাধ্যমে বিশেষ সুযোগ-সুবিধার বিলোপ সাধন করে সাম্যের পরিবেশ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টাউনি (Richard Henry Tawney) এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘স্বাধীনতা বলতে যদি মানবতার নিরবচ্ছিন্ন প্রসার বোঝায়, তাহলে সেই স্বাধীনতা কেবল সাম্যভিত্তিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাম্য স্বাধীনতার পরিপন্থি নয়, বরং স্বাধীনতার স্বার্থে সাম্য আবশ্যক।’ এ প্রসঙ্গে হার্বাট এ ডিন (Herbert A. Dean) বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা হলো সাম্যের সূচনা; স্বাধীনতা ও সাম্য পরস্পর বিরোধী নয় এমনকি পৃথকও নয় বরং একই আদর্শের দুটি দিকমাত্র।’
সুতরাং বলা যায়, সাম্য ব্যতীত স্বাধীনতা কার্যকর হতে পারে না। অর্থাৎ সাম্য ও স্বাধীনতা পরস্পর বিরোধী নয় বরং পরিপূরক।
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা হতে আপনারা স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক জানতে পারলেন। লেখাটি পড়ে ভালো লাগলে অন্যদের সাথে শেয়ার করার অনুরোধ রইলো।
আরও দেখুন:
সাম্য কাকে বলে? সাম্যের বিভিন্ন রূপ এবং সাম্য ও স্বাধীনতার সম্পর্ক আলোচনা কর