বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর ইতিবাচক এবং নেতিবাচক এ দুধরনের ভূমিকাই পালন করছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা আলোচনা করতে হলে এই দুই বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে হবে। – (দেখুন ১ম পর্ব)
নেতিবাচক ভূমিকা
১. গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট করে
পৃথিবীর কোন দেশেই সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কাম্য নয়। সামরিক বাহিনী দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী বাহিনী হিসাবে সর্বদা নিজেদের পেশাগত দক্ষতাবৃদ্ধি এবং উন্নতর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেদেরকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলা উচিত। তারা শাসনতন্ত্রের অধীন প্রজাতন্ত্রের বেতনভোগী কর্মচারী। দেশরক্ষা করা তাদের কাজ। কিন্তু কোন ভাবেই দেশ শাসন করা তাদের কাজ নয়।১৯৭৫ সালে বেসামরিক সরকারের দুর্বলতার সুযোগে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসে বেসামরিক প্রশাসনকে নিস্ক্রিয় করে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত করছে। সামরিক শাসকরা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উপর অযথা হয়রানি ও দমনমূলক নিপীড়ন চালিয়েছে। মূলত বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় এসে দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশকে নষ্ট করেছে।
২. অসংবিধানিক উপায়ে জোর পূর্বক ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা
সেনাবাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের পরে দেশের সংবিধানকে অকার্যকর বলে ঘোষণা করে এবং অবৈধ ও অসংবিধানিক উপায়ে ক্ষমতা চর্চা করে থাকে। সংবিধানিক উপায়ে নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্দিষ্ট সময়ের জন্য রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার অর্পনের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কিন্তু সামরিক শাসনকারীর ফলে বাংলাদেশে বহুদিন যাবৎ কোন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ বহুদিন নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা না করে জঙ্গী সামরিক আইন দ্বারা দেশ পরিচালনা করেছে এবং অবৈধভাবে ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করেছে। কার্যত সামরিক শাসন জারী থাকায় বাংলাদেশে বহুদিন সাংবিধানিক এবং নিয়মতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়েছে।
আরও পড়ুন:
বর্তমান বিশ্বে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রবণতা কমছে – ব্যাখ্যা কর।
৩. ক্ষমতার অপব্যবহার
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে মূলত পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতার অপব্যবহারের বিলুপ্তি সাধনের জন্য। ক্ষমতায় এসেই তারা তাদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যাপকহারে অত্যাচার নিপীড়ন এবং নির্যাতন চালিয়ে পূর্ববর্তীদের উপরে প্রতিশোধ নিয়েছেন। তাদের প্রতিশোধের মাত্রা এতই ভয়াবহ ছিল যে, এজন্য অনেকেই জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। দেশের সংবিধানকে স্থগিত ঘোষণা করে জিয়া এবং এরশাদ তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার মাধ্যমে তাদের ক্ষমতার দাপটে সেচ্ছাচারী শাসন চালিয়েছেন।
৪. অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে সিংহভাগ ভোগ
অর্থনৈতিক বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতারোহনের পর পরই পূর্ববর্তী সরকারের সাথে সমপাদিত চুক্তি অনুযায়ী ব্যাপক বৈদেশিক সাহায্য দেশে এসে পৌঁছে। তাছাড়া সামরিক বাহিনী দেশের ক্ষমতা দখল করেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রতিশ্রুতি প্রদান করা সত্বেও তারা তা পালন করতে পারেনি। কারণ সামরিক সরকারকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে অনেককেই খুশী করে অবৈধ সুযোগ দিয়ে টিকে থাকতে হয়। জিয়াউর রহমান এবং এরশাদের আমলে দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য যে সকল বৈদেশিক সাহায্য এসেছিল উন্নয়নের জন্য তার অতি সামান্য অংশই ব্যয় করা হয়েছিল। বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগই সামরিক বাহিনীর উচ্চ পদস্ত কর্মচারী ও তাদের কুকর্মের সহযোগি বেসামরিক আমলা এবং ঢাউট রাজনীতিবিদরা ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। এর ফলে দেশের উন্নয়ন বলতে শুধু রাজধানী কেন্দ্রিক কিছু নয়নাভিরাম দালান কোঠা আর রাস্তাঘাটে বিজলী বাতির ঝলকানি চোখে পড়েছে। দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে তেমন উন্নয়ন লক্ষ্য করা যায়নি।
৫. উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা
সামরিক বাহিনীর কখনো কখনো রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকেনা। ক্ষমতার বাইরে থেকে দেশের উন্নয়ন এবং পরিবর্তনের কথা খুব সহজেই বলা যায়, কিন্তু বাংলাদেশের মত দরিদ্র জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত একটি দেশে তড়িত উন্নয়ন সাধন করা অত্যন্ত কষ্ট সাধ্য এবং সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। বাংলাদেশে সামরিক শাসকরা ক্ষমতায় এসেই দেশের চেহারার আমূল পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে এমন কতগুলো পরিকল্পনা করেছিলেন যেগুলো বাস্তবায়ন করতে গিয়ে তারা ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। কারন এসকল পরিকল্পনা এমন উচ্চাভিলাসী বা শুধু মাত্র উন্নত দেশের জন্য প্রযোজ্য ছিল। সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সবসময় পাশ্চাত্য ভাবধারায় বিশ্বাসী হতে থাকে। তারা পাশ্চাত্য দেশগুলোর অনুকরনে পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়াস পায়। কিন্তু পাশ্চাত্যের দেশগুলোর আর্থ সামজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের সাথে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরাট ব্যবধান থাকায় সে সকল উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
৬. মৌলিক অধিকার হনন
মানুষের বাক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকার তার মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভুক্ত। দেশে সামরিক শাসন জারী করে সংবিধান স্থগিত ঘোষণা করা হয় এবং মানুষের কথা বলাও রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়। সামরিক বাহিনী অবৈধভাবে ক্ষমতায় এসে অবৈধ পন্থাতেই ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার জন্য মানুষের মৌলিক অধিকারের বেদিমূলে কুঠারাঘাত করে থাকে যা বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতেও প্রযোজ্য ছিল।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনীতির সামরিকীকরণ প্রক্রিয়া
৭. প্রচার মাধ্যমের কণ্ঠরোধ
সামরিক শাসকরা অবৈধ এবং অসংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতায় আসে। তাদের এই অবৈধ ক্ষমতারোহণের বিষয়টি বাংলাদেশের অশিক্ষিত অসচেতন জনগোষ্ঠী মেনে নিলেও জাতির বিবেক সাংবাদিকরা তা মেনে নেয়নি। তারা তাদের ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সামরিক সরকারের অবৈধ ক্ষমতা চর্চাকে নিন্দা জানিয়েছে, প্রতিবাদ করেছে। রেডিও, টেলিভিশন সরকারী প্রচার মাধ্যম হওয়ায় সেগুলো তেমন ভূমিকা পালন না করলেও সংবাদপত্র সপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং মাসিক পত্রিকাগুলোসহ অন্যান্য প্রচার মাধ্যমগুলো জিয়া ও এরশাদের বিরুদ্ধে তীব্র করাঘাত করেছে। সামরিক সরকাররা কখনই তাদের বিরুদ্ধাচারণ বরদাস্ত করতে পারেনি। তাই জিয়া এবং এরশাদের আমলে অনেক সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
৮. বিচার বিভাগের উপর হস্তক্ষেপ
বিচার বিভাগ হল দেশের সংবিধানকে রক্ষা করার রক্ষাকবচ। বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মাধ্যমেই দেশের সংবিধানিক কর্মকান্ডের নিশ্চয়তা সুনিশ্চিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সামরিক শাসন জারী হওয়ার ফলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। বিচারকদেরকে সকল পক্ষ পাতিত্বের উর্ধ্বে থেকে কাজ করতে দেয়া হয়নি। বরং প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা বিচার কার্য করা হয়েছে।
ইতিবাচক ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনী উপরোক্ত নেতিবাচক ভূমিকা পালন করলেও ইতিবাচক ভূমিকাও পালন করেছে। যা আলোচনা না করলে এ আলোচনাই অপূর্ণ থেকে যায়। নিম্নে এসব ইতিবাচক ভূমিকা আলোচনা করা হল:
১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা
বাংলাদেশের রাজনীতিতে উচ্চভিলাষী রাজনৈতিক নেতাদের অরাজনৈতিক পরিবেশ সুলভ আচরনের প্রেক্ষাপটে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল এবং দেশ আচ্ছাদিত ছিল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার আবর্তে। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে দমন এবং নির্যাতনের ফলে তারা সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে। যার ফলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। আর তখনকার অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থার অবসান ঘটানোর নিমিত্তে সামরিক বাহিনী দেশের সকল ক্ষমতা দখল করে শক্ত হাতে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশে স্থিতিশীলতা আনায়ন করে।
২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন
সামরিক বাহিনী দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করে দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক গতি সঞ্চার করেছে। সামরিক বাহিনী যেহেতু কারিগরি জ্ঞান সমৃদ্ধ বাহিনী সেহেতু তারা দেশের রাস্তাঘাট নির্মাণ, ব্রীজ নির্মাণ সহ অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করেছে।
পরিশেষে বলতে পারি যে, তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশে সামরিক বাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে অনেকটা নিজের প্রয়োজনে। ক্ষমতা লাভের পর তারা গণতান্ত্রিক পরিবেশও প্রতিষ্ঠান সমূহকে ধ্বংশ করে একক স্বৈরাচারী শাসন চালায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ১৯৭৫ সালে এবং ১৯৮২ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে সংবিধানকে অকার্যকর করেছিলেন। পরিশেষে আরও বলতে পারা যায় যে, সামরিক বাহিনী যতই উন্নয়ন করুক না কেন, বা জাতীয় উন্নয়নে অংশ গ্রহণ করুক না কেন, দেশের রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ মোটেই কাম্য নয়। কারন “সামরিক বাহিনীর কাজ দেশ রক্ষা করা, শাসন করা নয়।”