উন্নয়নশীল দেশসমূহে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ প্রায়ই ঘটে থাকে। এসব দেশে সামরিক বাহিনীকে একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সকল দেশে নানা কারণ দেখিয়ে সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। ১৯১৯ সালে আর্জেন্টিনায় প্রথম সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।
বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর উন্নয়নশীল দেশগুলো উপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ বেশি করে বৃদ্ধি পায়। অধ্যাপক তালুকদার মনিরুজ্জামান তার “Military Withdrawal From Politics” গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, ১৯৫৯ সালে রাষ্ট্র সমূহের ১২% সামরিক শাসনের আওতায় ছিল । ১৯৬১-৬৬ সালে এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৯% এ দাঁড়ায় এবং ১৯৭৩ সালে তা ২৭% এ উন্নীত হয়। কিন্তু অতি সম্প্রতি একটি প্রপঞ্চ পরিলক্ষিত হয়, আর তা হল তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রবণতা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
সামরিক হস্তক্ষেপ কি?
সামরিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে বেসামরিক কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সামরিক হস্তক্ষেপকে সংজ্ঞায়িত করেছেন। নিচে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহ উল্লেখ করা হল:
- E. Finer এর মতে, “বেসামরিক ক্রিয়াকলাপে বা দেশের শাসন কার্যে সামরিক বাহিনী জড়িয়ে পড়লে তাকেই সামরিক হস্তক্ষেপ বা সামরিক শাসন বলে। অর্থাৎ বেসামরিক কর্তৃপক্ষের জায়গায় সামরিক কর্তৃপক্ষ আসীন হবে বা বলপ্রয়োগের উপাদান নিহিত থাকবে”।
তিনি আরও বলেন, ”কোন শাসন ব্যবস্থাকে সামরিক শাসন হতে হলে সরকারকে অবশ্যই সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকতে হবে। সরকার সম্পূর্ণরূপে বা বহুলাংশে সেনাবাহিনীর নির্দেশ পালন করবে”।
নর্ডলিংগার তার “Soldiers in Politics” গ্রন্থে বলেন, “সামরিক হস্তক্ষেপ হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে সামরিক অফিসাররা তাদের প্রকৃত ক্ষমতা প্রয়োগ করে বা কর্তৃত্ব করে”।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনীতির সামরিকীকরণ প্রক্রিয়া
রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রবণতা হ্রাসের কারণ
সামরিক হস্তক্ষেপ হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে বেসামরিক কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীর প্রভাব বিস্তার। এটি প্রতক্ষ্য কিংবা পরোক্ষ উভয়ই হতে পারে। পূর্বে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যর্থতার সুযোগে সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ একটি নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। বর্তমান সময়ে, সামরিক বাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের প্রবণতা হ্রাস করতে যে সকল বিষয় ইতিবাচক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তা আলোচনার সুবিধার্থে চারটি ভাগে ভাগ করে নিচে তুলে ধরা হল-
ক. ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি
সাম্প্রতিককালে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণসচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে।তাই গণসচেতনতাকে নিম্নোক্ত শিরোনামে বিভক্ত করে আলোচনা করতে পারি:
১. বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আন্দোলন
উন্নয়নশীল দেশে অধুনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলে। তারা প্রয়োজনে সামরিক শাসনকে উৎখাত করার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে জোট গঠন করে। যেমন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে সামরিক শাসক এরশাদকে উৎখাত করার জন্য সকল রাজনৈতিক দল একসাথে আন্দোলন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের আন্দোলনের ভয়ে উন্নয়নশীল দেশে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা হ্রাস পাচ্ছে।
২. দুর্বার ছাত্র আন্দোলন
ছাত্রকে দ্বিতীয় শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী বলা হয়। তাই দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে সামরিক শাসনকে সহজে মেনে নিতে চায় না। ফলে তারাই প্রথম বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সূচনা করে।
উদাহরণ স্বরুপ, ১৯৬৭ সালের আইয়ুব বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, বার্মার সামরিক জান্তা নে উইনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন, ১৯৯০ সালের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ইত্যাদি সহ বিভিন্ন আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। এসব আন্দোলনে সচেতন ছাত্র সমাজ অনন্য ভূমিকা পালন করে। এ জাতীয় দূর্বার ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
৩. বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণীর আন্দোলন
একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশেই কেবল বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের বিভিন্নমূখী দাবী নিয়মতান্ত্রিকভাবে অর্জিত বা গৃহীত হতে পারে। সামরিক শাসনামলে এসব উপেক্ষিত হয়। ফলে শ্রমিক শ্রেণী, সাংবাদিক, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, চিকিৎসক প্রভৃতি পেশাজীবী শ্রেণী সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এতে করে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ ক্রমশ কমছে।
খ. পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতি
আন্তর্জাতিক রাজনীতি প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির পরিবর্তনের এ হাওয়া সামরিক অভ্যুত্থান কিভাবে প্রভাবিত করে তা নিম্নে আলোচনা করা হল:
১. বিশ্ব জনমতের প্রভাব
উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা, বাজার অর্থনীতি গোটা বিশ্বকে একটা Global village-এ পরিণত করেছে। বর্তমান বিশ্বে মানবাধিকার একটি বহুল আলোচিত বিষয় এবং এর মাধ্যমেই বিশ্বে ভ্রাতৃত্ব-বোধ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বিশ্ব জনমত আজ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখল ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ এ কারণেই ব্যাহত হচ্ছে।
২. বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের বিকাশ
সাম্প্রতিক কালে বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের সুবাতাস বইছে। ফলে আন্তর্জাতিক তথা পাশ্চাত্য শক্তিগুলো এখন গণতন্ত্রের বিকাশকেই অধিক প্রাধান্য দিচ্ছে বলে সামরিক বাহিনী তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারছেনা।
গ. অর্থনৈতিক কারণ
অর্থনীতি বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি নিয়ামক শক্তি। বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক কারণেও সামরিক বাহিনী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক কারণগুলো নিম্নরূপ:
১. মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রভাব
সাম্প্রতিক কালে মুক্তবাজার অর্থনীতির ফলে বিশ্ববাণিজ্য বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরাশক্তিগুলো অস্ত্রের পরিবর্তে অর্থকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক জোট গড়ে তুলেছে। সামরিক শাসন বা নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকলে অবাধ বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ কারণে রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
২. অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনে ব্যর্থতা
সামরিক বাহিনী যদিও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলে ক্ষমতা দখল করে কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায় তারা দেশের সামগ্রিক উন্নতি না করে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য এক বিশেষ শ্রেণী সৃষ্টি করে। ফলে দেশ চলে যায় ধ্বংসের দিকে। যেমন- এরশাদ আমলে বাংলাদেশের অবস্থা।
ঘ. সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা
সামরিক বাহিনীর কিছু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাও তাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করছে। সামরিক বাহিনীর কতিপয় অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা নিম্নরূপ:
১. বৈধতার সংকট
সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসে অ-সাংবিধানিক উপায়ে। ফলে তারা বৈধতার সংকটে ভোগে। বৈধতার সংকট কাটিয়ে উঠার জন্য তারা দীর্ঘ মেয়াদী বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন হয়। এই প্রক্রিয়া সহজসাধ্য নয় বিধায় সামরিক বাহিনী সম্প্রতি ঝুঁকি নিতে চায় না।
২. পেশাদারি মনোভাব বৃদ্ধি
সাম্প্রতিক কালে সামরিক বাহিনীর মধ্যে পেশাদারি মনোভাব সৃষ্টি হওয়ায় তারা কেবল তাদের দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যাপারেই ব্যাপৃত রয়েছে। যার ফলে সামরিক বাহিনীর মধ্যে রাষ্ট্র শাসন করার স্পৃহা কমে যাচ্ছে এবং তারা ক্ষমতা গ্রহণে আগ্রহী হচ্ছে না।
৩. সামরিক বাহিনীতে বহুত্ববাদ
সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রশ্নে খোদ সামরিক বাহিনীতেই নানা মতের সৃষ্টি হয়। ফলে একজন সেনানায়কের পক্ষে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো এবং সামরিক শাসন জারী করা বেশ কষ্টসাধ্য। কেননা সামরিক বাহিনীর সকলের মতামত এখানে জরুরি। এ ধরণের বহুত্ববাদী চরিত্রের কারণে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্র শাসন প্রশ্নে অভ্যন্তর থেকেই বাঁধার সম্মুখীন হচ্ছে।
তথ্যসূত্র:
- Military Withdrawal from Politics: A Comparative Study, by Talukder Maniruzzaman
- Soldiers in Politics: Military Coups and Governments. By Eric A. Nordlinger.