ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব
ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ বলতে গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের মনোজগত দখল করাকে বোঝায়। বাণিজ্যিক উপনিবেশবাদ শুধুমাত্র মানুষের মাটি ও দেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো, যা ছিলো সাধারণত ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু, ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ ভোক্তার মানসিক অবস্থাকে গ্রাস করে ফেলেছে। ভোক্তা কিভাবে পরিচালিত হবে তার পথ বাতলে দিচ্ছে। মানুষ কি চিন্তা করবে এবং কিভাবে আচরণ করবে, ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তা প্রভাবিত করছে।
সংস্কৃতি হলো মানুষের আচরণ। এটি ধারাবাহিকভাবে শিখতে হয়। আবার পর্যবেক্ষণের মাধ্যমেও নিজের আচরণে প্রয়োগ হয়। ঐতিহাসিক পূর্বপুরুষদের মাধ্যমে সংস্কৃতির ধারা অব্যাহত থাকে।
মিডিয়া বর্তমানে সংস্কৃতিকে চালিত করছে। এক দেশের সাথে আরেকদেশের ভাষা, অনুধাবন, শিক্ষা, পুনরাবৃত্তি, অনুষ্ঠান, ইতিহাস ইত্যাদি সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটছে। মানুষের মূল্যবোধ ও অনুধাবনকে প্রভাবন্বিত করছে মিডিয়া সংস্কৃতি।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, MTV, ESPN, CNN, Internet, Video Games ইত্যাদি দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রচারণা চালানো হচ্ছে পশ্চিমা সংস্কৃতির। যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক ফায়দাও লুটছে এসব দেশগুলো। এসব কাজ করছে জায়ান্ট মিডিয়া কোম্পানি দ্বারা। যেমন- Disney, Viacom, Sony, News Corporation ইত্যাদি। কোম্পানিগুলো দুভাবে কাজ করে।
১) অভিন্ন মাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ, এবং
২) ইমবেডিং সাংবাদিকতা – এক পক্ষীয় সংবাদ।
ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদের ফলে, এখন অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়াটাকে সভ্য জাতির পরিচয় বাহক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাছাড়া র্যাপ সংগীত, হলিউড সিনেমা, কনসার্ট, পাশ্চাত্য পোশাক, ভাষার ইচ্ছাকৃত বিকৃতি ইত্যাদি প্রবণতা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের দেশগুলোতে।
আরও পড়ুন: ভারতের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ না হওয়ার কারণসমূহ
দেশি মিডিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রচার করছে বিদেশী অনুষ্ঠানমালা। তারা খুব সস্তায় আধেয়গুলো পায়। আর পশ্চিমা গোষ্ঠী তা সরবরাহ করছে অবলীলায়। পত্র পত্রিকায় আন্তর্জাতিক সংবাদ প্রকাশের শতভাগই মিডিয়া জায়ান্টদের উপর নির্ভর করে দেশী প্রতিষ্ঠানগুলো। কেননা কারিগরি ও অর্থের অপ্রতুলতার কারণে তারা নিজেদের প্রোডাকশন করতে পারে না।
বিদেশী মিডিয়াগুলো তাদের সরবরাহকৃত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের মস্তিষ্ককে শোষণ করছে। যেখানে একজন পরিবারের সদস্যের পরামর্শের চাইতে মিডিয়ার পরামর্শকে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে।
দিনে দিনে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে হাইজ্যাক করেছে মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ। যে কোন গোষ্ঠী যদি তাদের প্রাচীন অবস্থা হতে আধুনিকায়নের দিকে যেতে চায় তাহলে মিডিয়া তাদের সামনে একটা মডেল দাঁড় করায়। একটা দেশ বা জাতি বা অঞ্চলকে দেখিয়ে দেয় অনুকরণীয় মডেল হিসেবে। গোষ্ঠীটির নিজস্ব জাতিসত্ত্বা, সংস্কৃতি জীবনব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। এজন্য মিডিয়ার এ অবস্থাকে “Empire of the mind” বলা হয়ে থাকে, যা কোন সীমানা বা বাধা মানে না। ইলেক্টনিক মাধ্যম ব্যবহারকারী শোনা, দেখা, বলার মাধ্যমে সেই রাজ্যে প্রজা হয়ে আছে। এ রকম প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের মাঝে বিদ্যমান থাকলে তাকে বলা হয়- ‘ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ’। আর এ ধারণাকে যা বৈধতা দেয় তাই হলো- ‘ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব’ বা “Electronic Colonialism Theory”.
ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্বের ইতিহাস
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমের সংবাদ প্রকাশে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো সারা বিশ্বের জন্য যোগাযোগীয় বার্তা পৌঁছানো ও সাংস্কৃতিক পণ্য উৎপাদন। এ লক্ষ্যে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল রেডিও সহ আরো কিছু গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় সংবাদ ও তাদের অনুষ্ঠান প্রচার শুরু করে।
শিল্প বিপ্লবের পর ও ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকের বড় বড় পরিবর্তনগুলো ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ বিকাশে ভূমিকা রাখে। এত করে জাতীয়তাবাদ, একীভূত উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রযুক্তির বিনিময় এবং পশ্চিমা রাজনৈতিক, অর্থনৈতির প্রসার ঘটে। পশ্চিমারা তাদের তথ্য প্রযুক্তি, কম্পিউটার ব্যবস্থা দিয়ে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় এবং অনুন্নতদের তাদের প্রতি নির্ভরশীল করে তুলতে সক্ষম হয়। ঐতিহ্যবাহী যোগাযোগ ব্যবস্থা, জাতীয় সীমারেখা ও প্রযুক্তিগত বাধা দূর হয়ে যায়। মূলত, এ পদক্ষেপগুলোই ইন্ডাস্ট্রিয়াল ও নন-ইন্ডাস্ট্রিয়াল যেমন- মিলিটারি, ধর্মভিত্তিক ও বাণিজ্যিক উপনিবেশকে ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে।
১৯৮০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসাবে রোনাল্ড রিগ্যান নির্বাচিত হলে তিনি গোটা উত্তর আমেরিকায় বেসরকারিকরণ, উদারীকরণ ও বিনিয়ন্ত্রণের নীতি গ্রহণ করেন। পরে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারও এতে জোরালো সমর্থন দেন। এ নীতিতে বাজার জোরদার করা, বিনামূল্যে সেবা, মালিকানাসত্ত্ব এবং মিডিয়া মার্জার করার উপর জোর দেয়া হয়। তৈরি হয় বড় বড় মিডিয়া জায়ান্ট।
মূলত এ সময়ের সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ থেকে জন্ম নেয় ইলেক্ট্রনিক উপনিবেশবাদ তত্ত্ব।