৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে বিরোধী দলীয় সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান নির্যাতিত, নিষ্পেষিত, অধিকার বঞ্চিত ‘বাঙালি জাতির পক্ষে যে ঐতিহাসিক ৬ দফা দাবি পেশ করেন তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং পরবর্তীকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পথ সুগমকরণে ৬ দফা কর্মসূচি এবং উক্ত কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলনের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিচে ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরা হলো-
প্রথমত, ৬ দফা আন্দোলনের মাধ্যমে জাগ্রত বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির এই। উদগ্র আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। ড. রওনক জাহান মনে করেন যে, ৬ দফা আন্দোলন ক্ষণস্থায়ী হলেও তা বাঙালি জাতির রাজনীতির ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন ঘটায়।
দ্বিতীয়ত, ৬ দফা আন্দোলন বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা যোগায়। এ আন্দোলন প্রমাণ করে যে, পূর্ব পাকিস্তান কেবল একটি প্রদেশ নয়, এটি একটি স্বাতন্ত্র ভৌগোলিক অঞ্চল। এ অঞ্চলের জনগণের একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তা আছে। স্বতন্ত্র ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আচার-আচরণ, রীতিনীতি ইত্যাদি কারণে তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।
হাজী শরীয়তুল্লাহ এর অবদান ও ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব |
তৃতীয়ত, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষাভাষী কতিপয় তরুণের প্রাণ উৎসর্গের মধ্য দিয়ে ১৯৫৬ সালের পাকিস্তান সংবিধানে বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলনে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষা ব্যবহারের সপক্ষে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়- যা বাঙালি জাতীয়তাবাদকে আরও সুদৃঢ় করে।
চতুর্থত, ৬ দফা কর্মসূচির প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেন যে, “Six point demand was the demand for the survival of the Bangalis.” মূলত পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়ন ও অবিচারের বিরুদ্ধে মুক্তির সনদ হিসেবে ৬ দফা ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করলে এ আন্দোলন আরও বেগবান হয়। পঞ্চমত, বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের যে উন্মেষ ঘটে তা ৬ দফা কর্মসূচির সংস্পর্শে এসে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয় এবং ৬ দফাভিত্তিক আন্দোলন এক পর্যায়ে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। এ আন্দোলনের মাধ্যমেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ সর্বপ্রথম সরকারি কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়।
ষষ্ঠত, ৬ দফা কর্মসূচিভিত্তিক আন্দোলন পরবর্তীকালে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন এবং একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথকে সুগম করে- যার সোনালি ফসল হিসেবে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা কর্মসূচি বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে- যার ফলশ্রুতিতে ধারাবাহিক সংগ্রামের মাধ্যমে অবশেষে ১৯৭১ সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদের চরম বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। শুরু হয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন অধ্যায়।
আশাকরি, উপরের আলোচনা থেকে আপনারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৬ দফার গুরুত্ব অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।