হাজী শরীয়তুল্লাহ এর পরিচয়
হাজী শরীয়তুল্লাহ ১৭৮৪ সালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার বাহাদুরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল জলিল তালুকদার। শিশুকালে ধর্মীয় শিক্ষকগণ কর্তৃক তিনি বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। ধর্মীয় শিক্ষাকে ব্যক্তিগত জীবনে অর্থবহ করে তোলার নিমিত্তে অল্প বয়সে মক্কায় গমন করেন। সেখানে প্রায় ২০ বছর অবস্থান করে ১৮১৮ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন। মক্কায় তিনি ওহাবী আন্দোলনের নেতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ ও সৈয়দ আহমদ ব্রেলভীর চিন্তাধারা দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। মক্কায় থাকাকালীন সময়ে তিনি সংকল্পবদ্ধ হন, দেশে ফিরে গিয়ে সমাজ সংস্কারে মনোযোগী হবেন। ১৮৪০ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ এর রাজনৈতিক অবদান আলোচনা কর |
হাজী শরীয়তুল্লাহ এর অবদান
হাজী শরীয়তুল্লাহ মনেপ্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি মুসলমান। যার কারণে তৎকালীন মুসলমান সমাজের কুসংস্কারগুলো তিনি বরদাশত করতে পারেন নি। মক্কা থেকে দেশে ফিরে তিনি সমাজ সংস্কারে মনোনিবেশ করেন। উনিশ শতকের প্রথমদিকে এ অঞ্চলে হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে যে আন্দোলন গড়ে ওঠে তাকে ফরায়েজি আন্দোলন বলে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দ্বিবিধ- (ক) আত্মবিশ্বাস জাগ্রতকরণ ও (খ) মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশ।
ক. ফরায়েজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করা। সে সময়ের মুসলমান সমাজ প্রবর্তিত পীর পূজা, কবর পূজা, মনসা পূজা, শীতলা পূজা ইত্যাদি নানা ধরনের অনৈসলামিক কার্য গোটা বাংলার মুসলমান সমাজকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা থেকে ধর্মীয় অনাচার ও কুসংস্কারগুলো বিদূরিত করে মুসলমানদেরকে প্রকৃত ধর্মীয় জ্ঞানালোকে উদ্বুদ্ধ করা এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে তোলা এ আন্দোলনের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। তিনি মুসলমানদের জীবনব্যবস্থা থেকে অনৈসলামিক কাজ পরিহার করার জোরালো নির্দেশ প্রদান করেন এবং মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে পবিত্রতা আনয়ন করার জন্য ইসলামের ‘ফরজ’ কাজগুলো অবশ্যম্ভাবীভাবে পালন করার উদাত্ত আহ্বান জানান। তাঁর আন্দোলনে ব্যবহৃত ‘ফরজ’ কথাটি থেকে ফরায়েজি কথাটি এসেছে। তাঁর প্রচেষ্টার ফলে অনেকেই কুসংস্কার মুক্ত হন।
খ. মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিস্তার ও অর্থনৈতিক দিকনির্দেশনা প্রদান হাজী শরীয়তুল্লাহর এ আন্দোলনের আরেকটি লক্ষ্য ছিল। সেই সাথে মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ করে ইংরেজদের অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে সচেতন করা। এ উদ্দেশ্যকে সামনে নিয়ে তিনি দরিদ্র কৃষক, তাঁতি ও শোষিত শ্রেণিকে মহাজন, জমিদার ও নীলকর বণিকদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনিই প্রথম রাজনৈতিক দূরবীক্ষণ দ্বারা অনুভব করেছিলেন ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান ছাড়া ভারতবর্ষের জনগণের মুক্তি অসম্ভব। তিনি ইসলামি জীবনাদর্শ সংবলিত রাষ্ট্রীয়’ ব্যবস্থা কায়েম করার স্বপ্ন দেখেন। এজন্য তিনি তদানীন্তন ভারতবর্ষকে ‘দারুল হরব’ বা বিধর্মীদের রাজ্য বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব
হাজী শরীয়তুল্লাহর এ আন্দোলন মুসলমানদের সামাজিক জীবনে গভীরভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। দলে দলে গ্রামবাংলার মুসলমানগণ ফরায়েজি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। সমাজজীবন থেকে কুসংস্কারগুলো দূর করতে মুসলমানগণ ইসলামি চেতনার সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পায়। মহাজন, জমিদার ও নীলকর বণিকদের বিরুদ্ধে মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামে অংশ নেয়। ইসলামি চেতনা ও দৃঢ় সংগ্রামী মনোবলে উজ্জীবিত মুসলমানদের নিকট মহাজন, জমিদার, নীলকর বণিক তথা অত্যাচারী শ্রেণি বিভিন্ন জায়গায় পরাজয় বরণ করে।
বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্য প্রচেষ্টায় দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের অবদান |
১৮৪০ সালে হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর এ আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র মুহাম্মদ মুহসীন ওরফে দুদু মিয়া। দুদু মিয়ার অপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা ও বিচক্ষন্নতার কারণে ফরায়েজি আন্দোলন জীবনীশক্তি ফিরে পায়। তাঁরই অক্লান্ত কর্ম তৎপরতায় এ আন্দোলন সামাজিক ও ধর্মীয় গন্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়। তাঁর লক্ষ্য ছিল কৃষকদেরকে জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুক্ত করে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। দুদু মিয়া সমগ্র বাংলাকে কয়েকটি অঞ্চলে বিভক্ত করেন। প্রতিটি অঞ্চলের শাসনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য তিনি একজন প্রতিনিধি বা খলিফা নিযুক্ত করেন। এসব প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকায় ফরায়েজি সংগঠিত করতেন। ১৮৪৩ সালে ফরায়েজির সংখ্যা ছিল প্রায় ৮০,০০০ (আশি হাজার)। বর্ষীয়ান ফরায়েজিদের দিয়ে আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। আদালত সব ধরনের বিরোধের বিচার করত। পূর্ব বাংলার কৃষককুল ও মুসলমানদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় ও আত্মশুদ্ধি আনয়নের ক্ষেত্রে তদুপরি জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তোলার ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলন এক মাইলফলক।