Home » ১৯৭২ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি গুলো কি কি?
১৯৭২ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি,

১৯৭২ সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি গুলো কি কি?

by TRI

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ

১৯৭২ সালের সংবিধানের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহের উল্লেখ আছে। আইরিশ ও ভারতীয় সংবিধানের অনুকরণে এ মূলনীতি সংযোজিত হয়। মূলনীতিসমূহের বাস্তবায়ন রাষ্ট্রের জন্য অবশ্য কর্তব্য; কিন্তু তা আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয়। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সমূহ নিচে বিশদভাবে তুলে ধরা হলো-

১. জাতীয়তাবাদ (Nationalism)

১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানের চারটি মূলস্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হলো জাতীয়তাবাদ। অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও মানসিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রাণধারা। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ৯ অনুচ্ছেদে বর্ণিত আছে, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছে; বাঙালি জাতির সেই ঐক্য ও সংহতিই হবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। আমরা বাঙালি, আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষা অন্যান্য সম্প্রদায় থেকে স্বতন্ত্র। আর জাতি হিসেবে নিজ দেশের জনগণের ওপর পূর্ণ কর্তৃত্বই বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। এ জাতীয়তাবাদ এটাই প্রমাণ করে, আমরা বাঙালি, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, বাংলাদেশ আমাদের মাতৃভূমি। আর আমরা একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জাতি।

২. সমাজতন্ত্র (Socialism)

১৯৭২ সালের বাংলাদেশ সংবিধানে সন্নিবেশিত রাষ্ট্র পরিচালনার আরেকটি মূলনীতি হলো সমাজতন্ত্র। শোষণমুক্ত ও সমতাভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করার পরিকল্পনা করা হয়। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, মানুষের উপর মানুষের শোষণ হতে মুক্ত ন্যায়ানুগ সমাজ লাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনেতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হলো রাষ্ট্রের লক্ষ্য, এর অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা। তবে চীন কিংবা সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়নি। বরং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদ বিকাশে ৬ দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য

৩. গণতন্ত্র (Democracy)

সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে পরিগণিত হবে। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে বলা হয়, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হবে একটি গণতান্ত্রিক। রাষ্ট্র যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে।” গণতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়, বাংলাদেশের সকল পর্যায়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কার্যকর অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা রাখা হয়।

৪. ধর্মনিরপেক্ষতা (Secularism)

১৯৭২ সালের সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্র পরিচালনার আরেকটি উল্লেখযোগ্য মূলনীতি হলো ধর্মনিরপেক্ষতা। সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়, “রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার, কোনো বিশেষ ধর্মপালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার উপর উৎপীড়ন করা হবে না।” অর্থাৎ সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটিয়ে সকল নাগরিকের পূর্ণ ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা।

এছাড়া রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোও উল্লেখ করা হয়-

i. মালিকানার নীতি: সংবিধানের ১৩ অনুচ্ছেদে ত্রিবিধ মালিকানার উল্লেখ করা হয়। যথা- ক. রাষ্ট্রীয় মালিকানা তথা রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ওপর জনগণের পক্ষে রাষ্ট্রের মালিকানা। খ. সমবায় মালিকানা ও গ. ব্যক্তিগত মালিকানা।

ii. কৃষক-শ্রমিকের মুক্তি: সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব হবে কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষকে সকল প্রকার শোষণের হাত থেকে ১সা মুক্তি দান।

iii. মৌলিক প্রয়োজনের সুব্যবস্থা: সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়, রাষ্ট্র নাগরিকের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। যুক্তিসঙ্গত মজুরি, বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তা বিধান করবে।

iv. গ্রামীণ উন্নয়ন: শহর ও গ্রামীণ জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য দূরীকরণের লক্ষ্যে রাষ্ট্র কৃষি বিপ্লব, কুটির শিল্পের বিকাশ, বিদ্যুতায়ন, শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করবে।

V. শিক্ষানীতি: ‘সবার জন্য শিক্ষা’ এ লক্ষ্যে শিক্ষাকে গণমুখী ও সর্বজনীন করা, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান, নিরক্ষরতা দূর করা এবং সমাজের প্রয়োজনের সাথে সংগতিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

vi. জনস্বাস্থ্য: জনস্বাস্থ্যের উন্নতির লক্ষ্যে রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এছাড়া মদ্যপান, গণিকাবৃত্তি, জুয়াখেলা ইত্যাদি নৈতিকতাবিরোধী কার্যকলাপ নিরোধের ব্যবস্থা করবে।

vii. সমতা নীতি: সকল নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা বিধান এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনে রাষ্ট্র সচেষ্ট থাকবে।

viii. কর্মের নীতি: প্রত্যেক ব্যক্তি তার স্বীয় কর্মের জন্য পারিশ্রমিক লাভ করবে। প্রত্যেকের নিকট থেকে যোগ্যতানুযায়ী ও প্রত্যেকে কর্মানুযায়ী এ নীতি অনুসরণ করা হবে।

ix. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ যাতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ থেকে বিচারকার্য পরিচালনা করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

x. আন্তর্জাতিক নীতি: স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্যান্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ মীমাংসা, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নীতির ভিত্তি।

Related Posts