জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা
জাতীয়তাবাদ এক ধরনের আদর্শগত চেতনা। এটি যখন মানবকল্যাণ এবং জনগণের প্রয়োজনের তাগিদে সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে নতুন জাতীয় চেতনার জন্ম দেয়, তখন এটি প্রকৃত অর্থেই জনসাধারণের রাজনৈতিক আদর্শে পরিণত হয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদ যখন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয় এবং আবেগসর্বস্ব দেশপ্রেমের আবরণে কোনো গোষ্ঠীর সংকীর্ণ স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তা আর ইতিবাচক আদর্শ থাকে না। মানবসভ্যতার জন্য বিকৃত ও উগ্র জাতীয়তাবাদ অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। তাই বিভিন্ন চিন্তাবিদ জাতীয়তাবাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করেছেন। নিচে জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতা গুলো আলোচনা করা হলো-
গণতন্ত্রবিরোধী
উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বদা গণতন্ত্রবিরোধী। কারণ গণতন্ত্রের শিক্ষা হলো সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গণতন্ত্র বারবার বিলুপ্ত হয়েছে। শাসকশ্রেণি প্রায়শই অগণতান্ত্রিক ক্ষমতালিজু শোষকরূপে আবির্ভূত হয়। তখন উগ্র জাতীয়তাবাদ হয়ে ওঠে তাদের অন্যতম হাতিয়ার। তারা গণতন্ত্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দ্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। জার্মানির নাৎসিবাদ ও ইতালির ফ্যাসিবাদ ইতিহাসের পাতায় গণতন্ত্রবিরোধী জাতীয়তাবাদের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে।
মানবতাবিরোধী
উগ্র জাতীয়তাবাদ অনেক সময় মানবতার শত্রু হিসেবে আবির্ভূত হয়। কারণ উগ্র জাতীয়তাবাদ অনেক সময় মানবিক বিপর্যয় ঘটায় এবং বিপদ ডেকে আনে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জামান নেতা অ্যাডলফ হিটলারের যুদ্ধংদেহী আচরণ এবং বিশ্বজুড়ে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের সূত্রপাত উগ্র জাতীয়তাবাদের ভয়াবহতার প্রমাণ। সাম্প্রতিক উদাহরণ হিসেবে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটের কথা উল্লেখ করা যায়। একশ্রেণির উগ্র জাতীয়তাবাদী বর্মী সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমার রাষ্ট্রের নিপীড়নে উস্কানি দিচ্ছে। এটি সাম্প্রতিককালের অন্যতম বৃহৎ শরণার্থী সংকটের সৃষ্টি করেছে। রুশ চিন্তাবিদ ভ্লাদিমির সোলোভব (Vladimir Solovyovi বলেন- ‘জাতীয়তাবাদ উগ্র হলে জাতিকে বিনষ্ট করে, কেননা তখন সে নিজেকে মানবতার শত্রুতে পরিণত করে’।
জনমতের সীমাবদ্ধতা বা ত্রুটিগুলো আলোচনা কর |
সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্টি
উগ্র জাতীয়তাবাদ অনেক সময় সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো জাতীয়তাবাদী অহংয়ের কারণে অপেক্ষাকৃত দুর্বল এবং দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর ওপর বিভিন্নভাবে প্রস্তুত্ব করে থাকে। তারা সাহায্য-সহযোগিতার নামে দরিদ্র দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করে।
বিশ্বশান্তির পরিপন্থি
জাতীয়তাবাদ উগ্র হলে যুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি হয় এবং বিশ্বশান্তি হুমকির মুখে পড়ে। উগ্র জাতীয়তাবাদীরা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য অন্য দেশে আক্রমণ করে বসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে অন্যতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় উগ্র জাতীয়তাবাদী আদর্শ অনুসরণের অভিযোগ উঠেছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের তৎপরতা দেখা যায়।
অন্ধ আবেগ
অনেক সময় দেশপ্রেম এবং জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা থেকে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। কিন্তু অন্ধ আবেগের কারণে এটি জাতিগত অহংকারে পরিণত হয়। ফলে অন্য জাতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা নষ্ট হয়। কারণ কখনো কখনো আবেগতাড়িত হয়ে মানুষ অন্যকে কোনো বিষয়ে স্বীকৃতি দিতে চায় না। তারা অন্য জাতির অধিকারকে অস্বীকার করে।
বিদ্বেষ সৃষ্টি
উগ্র জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে কোনো জাতি নিজেদের অন্যান্য জাতি থেকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠ মনে করে। ফলে অন্য জাতির প্রতি তারা বিদ্বেষ বা তাচ্ছিল্য পোষণ করে। জাতীয়তাবাদ নেতিবাচক উন্মাদনা সৃষ্টি করে বলে অনেক সময় মানবসভ্যতা সংকটে পড়ে।
অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি
উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে অনেক সময় অর্থনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়। বিশ্বের শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর বিরুদ্ধে বাণিজ্য লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এতে কারো কারো লাভ হলেও বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো অনেক সময় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ওপর অর্থনৈতিক অবরোধও আরোপ করে থাকে।
উদ্বাস্তু সমস্যা
উগ্র জাতীয়তাবাদের কারণে যুগে যুগে বিশ্বের অনেক মানুষ মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতিগোষ্ঠীর চাপে কোণঠাসা হয়ে বা যুদ্ধের কারণে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অনেক মানুষের বাস্তুহারা হওয়ার ঘটনা কমবেশি ঘটেছে। মিয়ানমারের লাখ লাখ রোহিঙ্গার উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে পাড়ি জমানোর পেছনে অন্যতম কারণ হচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ।
উপরের আলোচনা থেকে বলা যায়, মানবিকতা বিবর্জিত জাতীয়তাবাদ বিপর্যয় ডেকে আনে। অথচ জাতীয়তাবাদের জন্ম ও বিকাশ হয়েছিল ঐক্য ও মুক্তির আদর্শকে সামনে রেখে। উগ্র জাতীয়তাবাদ কেবল জাতিতে জাতিতে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। তাই এটি একান্তই পরিত্যাজ্য।