গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ
দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন পাক কিন হে। তিনি ‘সেনুরি’ পার্টির প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। পাক কিন হে একজন নারী এবং তিনি নাগরিকদের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হন। সাধারণ নাগরিকরা ভোটদানের সময় বিষয়টি ভাবেনি যে তিনি একজন নারী। নারী পুরুষ বিবেচনা নয় বরং দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকগণ চিন্তা করেছে যে, তিনি দেশকে ভালোভাবে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবেন। দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকদের এ ভাবনা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরই বহিঃপ্রকাশ। গণতন্ত্র হলো একটি মতাদর্শ। কারও দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হলো একটি সমাজব্যবস্থা আবার কারও দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হলো বিশেষ ধরনের জীবনব্যবস্থা। এর দ্বারা বোঝা যায়, গণতন্ত্রের পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। গণতন্ত্রের ধারণার সাথে কতকগুলো নীতি, আদর্শ ও আচরণবিধি জড়িত থাকে যেগুলো গণতন্ত্রকামী জনগণ গ্রহণ করতে ইচ্ছুক হয়। আর সেটাই হচ্ছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ (Democratic Values)।
আরও দেখুন: স্বাধীনতা ও সাম্যের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা কর
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপাদান
১. জীবনের নিশ্চয়তা
নাগরিকের জীবন রক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের সুবন্দোবস্ত করা এবং কেউ যাতে কারো প্রাণহানি করতে না পারে তার জন্য আইনগত ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। নাগরিক হিসেবে কেউ অন্য কারো জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াবে না। মানুষকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করাই হলো এ মূল্যবোধের উদ্দেশ্য।
২. স্বাধীনতা
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। অন্যের কাজে হস্তক্ষেপ না করে নিজের অধিকার ভোগ করা, মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সরকারের সমালোচনার অধিকার এ মূল্যবোধের অন্তর্গত। কোনো কারণে নাগরিকের বৈধ স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। অপরের মত আমার পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু তা প্রকাশে বাধা দেওয়া যাবে না এটিই মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
৩. রাজনৈতিক অংশগ্রহণ
গণতন্ত্র হলো জনগণের শাসন। তাই রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করার অধিকার এবং তার অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখা, স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, ভোটাধিকার প্রয়োগ করা, সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের সমালোচনা করা প্রভৃতি রাজনৈতিক অংশগ্রহণের অন্তর্ভুক্ত।
৪. ঐকমত্য
জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য পোষণ করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অন্যতম উপাদান। ব্যক্তির বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠন ও সরকারের সমালোচনার অধিকার থাকবে। তাই বলে সকল ক্ষেত্রেই সরকারের সমালোচনা না করে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর প্রতি ঐকমত্য প্রদর্শন করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ।
৫. সাম্য
কারও জন্য বিশেষ সুযোগ-সুবিধা না থাকা এবং সকলের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করার নামই সাম্য। মানুষের বিভিন্নমুখী বিকাশ সাধনের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হিসেবে সাম্যের মূল ধারণা হলো জাতি, ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক সাম্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও তা কার্যকর করতে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৬. ন্যায়বিচার
সমাজের সুযোগ-সুবিধা ও বাধ্যবাধকতার ক্ষেত্রে সকল নাগরিককে একই দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করাই হলো ন্যায়বিচার। জাতি, ধর্ম-বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে গণতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেকেরই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, আইনগত ন্যায়বিচারের ধারণাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের উপাদান।
৭. জাতিগত সম্প্রীতি
জাতিগত সম্প্রীতিকে সমুন্নত রাখা এবং এটিকে রাষ্ট্রীয় শক্তির অংশ মনে করা অন্যতম। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। জাত-পাত নিয়ে বিতর্ক, শ্রেণি-বর্ণের বিন্যাস, দ্বীনের অযাচিত প্রশ্ন, জাতিগত তাত্ত্বিক মূল্যায়ন পরিহার করে জাতিগত সম্প্রীতি সমুন্নত রাখা হলো গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অংশ। গণতন্ত্রের এ মূল্যবোধ সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পকে চিরতরে নির্মূল করে।
৮. স্বচ্ছতা
সরকার তার সকল কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা বজায় রাখবে। নাগরিকগণও তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে স্বচ্ছতা বজায় রাখবে। এমনটিই প্রত্যাশা করা হয় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মধ্যে অযাচিত গোপনীয়তা সৃষ্টি করা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থি।
৯. জনগণের সার্বভৌমত্ব
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র হলো জনগণের। জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হলো জনগণের সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করা ও তা কার্যকর করা। রাষ্ট্র বা অন্য কোনো সংস্থা বা ব্যক্তির সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পরিপন্থি।
১০. দেশাত্মবোধ
জনগণ তাদের কথা ও কাজের মধ্য দিয়ে দেশাত্মবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে এটিই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের কাম্য বিষয়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেহেতু জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় সেহেতু জনগণ দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসে। নিজেদেরকে রাষ্ট্রের মালিক মনে করার কারণে দেশাত্মবোধের প্রকাশ ঘটানোও সহজ হয়। দেশকে রক্ষা এবং দেশের সম্মানকে বিশ্বের দরবারে সমুন্নত করা দেশাত্মবোধের অংশ।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের এ উপাদানগুলো ছাড়াও আরও কতকগুলো উপাদান রয়েছে যেগুলো সাংবিধানিকভাবে কার্যকর থাকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সাংবিধানিক উপাদানগুলো হলো আইনের শাসন, ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি, মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি, ধর্মীয় স্বাধীনতা, জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণাধীন সেনাবাহিনী, জবাবদিহিমূলক প্রশাসন ইত্যাদি।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গুলো রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য, নাগরিকদের দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তরিত করার জন্য এবং রাষ্ট্রকে আধুনিকতার দোরগোড়ায় পৌঁছে দেবার জন্য গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কাজ করে থাকে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ হলো একটি অনুশীলন যার লক্ষ্য হলো রাষ্ট্রের দৃষ্টি দিয়ে নাগরিকদেরকে দেখা নয় বরং নাগরিকদের দৃষ্টি দিয়ে রাষ্ট্রকে দেখা। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন একজন নাগরিকের পক্ষেই সম্ভব অন্যের অনুভূতিকে শ্রদ্ধা করা যা নিরপেক্ষভাবে মানবকল্যাণকে ত্বরান্বিত করতে পারে।