রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সঠিক মতবাদ
রাষ্ট্রের উৎপত্তি কখন, কীভাবে হয়েছে সে সম্পর্কে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানে একাধিক মতবাদ প্রচলিত আছে। ইতিহাস থেকে জানা যায় আদিম সমাজে রাষ্ট্র নামক কোনো প্রতিষ্ঠান ছিল না। আদিম যুগের অসংগঠিত মানুষ সহজাত প্রবৃত্তি ও নিরাপত্তার তাগিদে সংঘবদ্ধ জীবন যাপন শুরু করে। সংঘবদ্ধ জীবন যাপনের এক পর্যায়ে সমাজ থেকে রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। কোনো কোনো চিন্তাবিদ মনে করেন, বিধাতাই রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছেন। কারণ তারা দেখেছেন, রাষ্ট্র বিবর্তনের এক পর্যায়ে ধর্মের গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশি। আবার কোনো কোনো চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের মতে, অতীতে সমাজে প্রথম উৎপত্তি হয়েছিল পরিবার। তখন কোথাও পিতৃতান্ত্রিক আবার কোথাও মাতৃতান্ত্রিক পরিবার প্রথা বিদ্যমান ছিল। সুতরাং পরিবার সম্প্রসারিত হয়ে গোষ্ঠী, গোষ্ঠী থেকে উপজাতি, উপজাতি থেকে জাতি এবং জাতি সম্প্রসারিত হয়ে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। এভাবে পিতৃতান্ত্রিক ও মাতৃতান্ত্রিক পরিবার থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। আবার কেউ কেউ মনে করেন, রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূলে রয়েছে শক্তির বিশেষ ভূমিকা। কিছু কিছু সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সমসাময়িক সমাজব্যবস্থার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বলেন যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে সমাজে বসবাসকারী মানুষের পারস্পরিক চুক্তির ফলে। কোনো কোনো রাষ্ট্রচিন্তাবিদ রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে বিভিন্ন উপাদানের ভূমিকা তুলে ধরে বিবর্তনবাদ বা ঐতিহাসিক মতবাদের অবতারণা করেন।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানে ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনেক মতবাদের উল্লেখ আছে। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মতবাদ হলো:
১. ঐশ্বরিক বা বিধাতার সৃষ্টিমূলক মতবাদ
২. পিতৃতান্ত্রিক মতবাদ
৩. মাতৃতান্ত্রিক মতবাদ
৪. শক্তি প্রয়োগ বা বল প্রয়োগ মতবাদ
৫. সামাজিক চুক্তি মতবাদ
৬. ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ
এই মতবাদ গুলোর মধ্যে রাষ্ট্রের উৎপত্তি সংক্রান্ত সঠিক মতবাদ হলো ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ। নিম্নে এই মতবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদ
রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে মতবাদগুলোর মধ্যে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদই সর্বজনস্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য মতবাদ। রাষ্ট্রের উৎপত্তির অপরাপর মতবাদগুলো একটি মাত্র উপাদানের উপর গুরুত্ব আরোপ করায় সেগুলো ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে। আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে, অন্যসব মতবাদ অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত । তারা রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদকে সঠিক বলে চিহ্নিত করেছেন। এ মতবাদের প্রধান সমর্থকগণ হলেন অধ্যাপক গার্নার, লীকক, বার্জেস, ম্যাকাইভার প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্রচিন্তা কি? রাষ্ট্রচিন্তায় এরিস্টটলের অবদান আলোচনা কর
মূল বক্তব্য: ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে রাষ্ট্র আকস্মিকভাবে একটি নির্দিষ্ট সময়ে সৃষ্টি হয়নি। মানব সমাজের ক্রমবিকাশের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন উপাদান ও শক্তির ভূমিকার ফলে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়েছে। বর্তমানকালের রাষ্ট্র সুদীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের ক্রমবিকাশের ফল। তাই এই ক্রমবিকাশের মতবাদটিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ ঐতিহাসিক মতবাদ বা বিবর্তনমূলক মতবাদ নামে আখ্যায়িত করেছেন। অধ্যাপক গার্নার (Garner)-এর ভাষায়, রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্টি নয়। দৈহিক বল প্রয়োগের ফলও নয়, কোনো প্রস্তাব বা সম্মেলনের দ্বারা রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়নি; এমনকি পরিবারের সম্প্রসারণের ফলে এর সৃষ্টি হয়নি। রাষ্ট্র কোনো কৃত্রিম বা যান্ত্রিক উপায়ে সৃষ্টি নয়, রাষ্ট্র ঐতিহাসিক বিবর্তনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে।“
অধ্যাপক স্টিফেন বাটলার লীকক (Stephen Butler Leacock)-ও অনুরূপ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, “মানুষের ইতিহাসের জানা অজানা অধ্যায় হতে রাষ্ট্র বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে।”
অধ্যাপক বার্জেস (Burgess) বলেন, “রাষ্ট্র মানব সমাজের মোটামুটিভাবে অসম্পূর্ণ অবস্থা থেকে অমার্জিত কিন্তু উন্নতি সাধক অবস্থার অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে সম্পূর্ণ ও সর্বজনীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে।”
রাষ্ট্রের উৎপত্তির মূলে বিভিন্ন উপাদান কাজ করেছে। যেমন–
সামাজিক বা সহজাত প্রবৃত্তি, পরিবার ও রক্তের সম্পর্ক, ধর্মীয় বন্ধন, অর্থনৈতিক কার্যকলাপ, যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব সংঘাত, রাজনৈতিক চেতনা। নিম্নে রাষ্ট্র গঠনে এ উপাদানগুলোর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
১. সামাজিক বা স্বাভাবিক প্রবৃত্তি
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো (Plato)-এর মতে, রাষ্ট্র কোনো পাশবিক শক্তির ফল নয়। সামাজিক প্রয়োজনে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়েছে। প্লেটোর ভাষায়, “রাষ্ট্র কোনো ওক বৃক্ষ বা শিলা থেকে উদ্ভব হয়নি বরং মানুষই রাষ্ট্র গঠনের মূল ভিত্তি।” এরিস্টটলও (Aristotle) রাষ্ট্রের উৎপত্তির বিবর্তনমূলক মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর মতে, “রাষ্ট্র স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছে এবং এটা একটা স্বাভাবিক সংস্থা। মানুষের পক্ষে পরিবার যেমন স্বাভাবিক, রাষ্ট্রও তেমনি স্বাভাবিক।” জন মর্লে (Morley)-এর মতে, “মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির মধ্যে রাষ্ট্রের উদ্ভবের প্রকৃত কারণ খুঁজে পাওয়া যাবে। মানুষের ভাষার মতো রাষ্ট্রও স্বাভাবিক প্রয়োজনে ধীরে ধীরে বিকশিত হয়েছে।” সুতরাং বলা যায় যে, মানুষের সামাজিক প্রবৃত্তি রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মানুষের সামাজিকতাবোধের উপাদান রাষ্ট্রের বিবর্তনে মৌলিক বিষয় হিসেবে কাজ করেছিল।
২.পরিবার ও রক্তের সম্পর্ক
রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে পরিবার ও রক্তের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মানব সমাজের আদি সংগঠন হলো পরিবার। রক্তের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে পরিবার গড়ে ওঠে। কালক্রমে পরিবারের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে গোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। তখন গোষ্ঠী প্রধান স্বীয় গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব– সংঘাত মীমাংসা করতেন এবং শাসক হিসেবে ভূমিকা পালন করতেন। ক্রমান্বয়ে গোষ্ঠী সম্প্রসারিত হয়ে উপজাতির সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন উপজাতি–প্রধান রক্তের সম্পর্কের ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংহতি সাধনে ঐক্যের বন্ধনকে সুদৃঢ় করে। ফলে উপজাতি থেকে জাতি এবং জাতি থেকে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। অধ্যাপক ম্যাকাইভার (Maclver) বলেছেন, “রক্তের সম্পর্ক সমাজ সৃষ্টি করে এবং সমাজ শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্র সৃষ্টি করে।” স্যার হেনরি মেইন (Sir Henry Main) পরিবার ও রক্তের সম্পর্কের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “সমাজের আদিম ইতিহাস সম্পর্কে সাম্প্রতিক গবেষণা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, অতীতে যে সকল উপাদান মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছে তা হলো রক্তের সম্পর্ক বা আত্মীয়তা।”
আরও পড়ুন: প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার প্রকৃতি পরিধি ও বিষয়বস্তু আলোচনা কর
৩. ধর্মীয় বন্ধন
জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে রক্তের সম্পর্কের বন্ধন শিথিল হয়ে গেলে ধর্ম বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে এবং রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। আদিম যুগের মানুষ বন্যা, ঝড়, বৃষ্টি, বজ্রপাত প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখে ভয় পেত। এগুলো থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য তারা ধর্ম–কর্ম ও পূজা–পার্বণ সৃষ্টি করে। গোষ্ঠী–প্রধান হয়ে উঠেন একাধারে ধর্মীয় নেতা ও শাসক। তিনি ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনা করতেন। বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষ তাদের ধর্মীয় নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও আনুগত্যশীল হয়ে ওঠে। মানুষ ধর্মীয় নেতার আদেশ–নির্দেশকে ঈশ্বরের আদেশ–নির্দেশ বলে মনে করে। ফলে একই ধর্মীয় বিশ্বাস, একই উপাসনা পদ্ধতি ও একই ধর্মীয় আইনকানুন মানুষকে বৃহত্তর ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। এ ধরনের ঐক্যবোধ রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করে। অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেন, “রাজনৈতিক বিবর্তনের সর্বাপেক্ষা প্রারম্ভিক ও সংকটময় মুহূর্তে একমাত্র ধর্মই মানুষকে শ্রদ্ধা ও আনুগত্য শিখিয়ে বর্বরোচিত নৈরাজ্য দমন করতে পেরেছিল।” মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন (Woodrow Wilson) বলেন, “ধর্ম ছিল রক্তের বন্ধনের প্রতীক, একতার, পবিত্রতার এবং কর্তব্যসমূহের প্রকাশ।” অধ্যাপক গেটেল (Gettell) ধর্মের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “হাজার হাজার বছর প্রয়োজন হয়েছিল নিয়মানুবর্তিতা ও কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রতিষ্ঠিত করতে। যার উপর নির্ভরশীল ছিল অতীতের সকল সফল সরকারসমূহ। অতীতে এই ভূমিকা পালন করেছে ধর্মতত্ত্ব ও স্বৈরশাসক যার পিছনে ছিল অতি প্রাকৃত শক্তি সম্পর্কে ধর্মের অনুমোদন।”
৪. অর্থনৈতিক কার্যকলাপ
রাষ্ট্রের উৎপত্তিতে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করেছে। আদিম সাম্যবাদী সমাজে মানুষ গোষ্ঠীবদ্ধভাবে খাদ্য আহরণের জন্য বনে–জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। যা কিছু সংগৃহীত হতো তা সকলে মিলে সমভাগে ভোগ করত। শিকার পরিচালনার জন্য তখন গোষ্ঠীর একজনকে নেতা বানানো হতো। ক্রমে ক্রমে মানুষ বন্য পশুকে পোষ মানিয়ে পশু পালন করতে শিখল। ফলে গড়ে ওঠে পশু পালক সমাজ। তারপর কৃষি আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক কাজ–কর্ম ও ধন–সম্পত্তি বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে পুঁজি বৈষম্য দেখা দেয়। কৃষি ছাড়াও বিভিন্ন পেশার উদ্ভব ঘটে। ফলে শ্রমবিভাগ দেখা দেয় এবং দ্রব্য বিনিময় ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে ব্যবসা–বাণিজ্যের সূচনা হয়। এভাবে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষা, উত্তরাধিকার নির্ধারণ, বণ্টন নীতি, সম্পত্তিকে ঘিরে দ্বন্দ্ব– সংঘাত নিরসন ইত্যাদি বিষয়ে আইন–কানুন প্রণয়ন এবং শাসনযন্ত্রের প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়ে। তাই অধ্যাপক গেটেল (Gettell) বলেন, “সম্পত্তি ও পেশাগত বৈষম্য বিভিন্ন শ্রেণি সৃষ্টি করেছে এবং এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণের পথ উন্মুক্ত করেছে। এ থেকেই রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের সৃষ্টি হয়েছে।”
৫.যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব সংঘাত
আদিম সমাজের জনগোষ্ঠী রক্তের সম্পর্কের বন্ধনে সুখে–শান্তিতে বসবাস করত। কালক্রমে অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব–সংঘাত বাঁধে। তবে এই যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব–সংঘাতের পিছনে ক্ষমতা, প্রভাব–প্রতিপত্তি ও গৌরব অর্জনের প্রবণতাও কাজ করত। আন্তঃগোষ্ঠীয় দ্বন্দ্ব–সংঘাত বিস্তৃত হলে বিভিন্ন উপজাতির মধ্যে যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব–সংঘাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এই যুদ্ধ– বিগ্রহের মাধ্যমে যে উপজাতীয় নেতা জয়লাভ করত সে পরাজিত উপজাতিগুলোর উপর প্রভুত্ব স্থাপন করত। এভাবে উপজাতিদের মধ্য থেকে সার্বভৌম ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধনায়কের সৃষ্টি হয়। তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করা ছাড়াও শাসন কার্য পরিচালনা করতেন। ক্রমান্বয়ে উপজাতীয় নেতা ও শাসক বিশাল ভূখণ্ডের উপর নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হয়। ইতালির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাকিয়াভেলি ও ফরাসি চিন্তাবিদ জিন রভিন মনে করেন যে, “যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানের উৎপত্তি হয়েছে।” রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জেংকস (Zenks) বলেন, “War begets the king, the instinct of self defence against the common enemy united small states into powerful league in the past.” ভলটেয়ার (Voltayer) বলেন যে, “সৌভাগ্যবান যোদ্ধাই প্রথম রাজার পদ অলংকৃত করে।“
৬. রাজনৈতিক চেতনা
আদিম যুগ থেকেই মানুষ সহজাত প্রবৃত্তির বশে সংঘবদ্ধভাবে বাস করত। তবে এই সংঘবদ্ধতার কারণ সম্পর্কে তারা ছিল অচেতন। তাই আদিম যুগকে অন্ধ আনুগত্যের যুগ বলা হতো। কালক্রমে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের বিভিন্ন ঘাত–প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে গোষ্ঠীপতি ও নেতার জন্ম হয়। বিভিন্ন জাতির মধ্যে দ্বন্দ্ব–সংঘাতের ফলে উপজাতিগুলো নিজেদের ঐক্য সম্পর্কে সচেতন হতে থাকে। উপজাতিগণ জীবন, স্বাধীনতা, সম্পত্তি রক্ষা এবং আত্মরক্ষার জন্য উপজাতীয় নেতার নিকট আনুগত্য দেখায়। আস্তে আস্তে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। ক্রমে ক্রমে ব্যবসা–বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারিত হয়। ফলে মানুষ কোনো ব্যক্তির উপর এসব দায়িত্ব না দিয়ে কেন্দ্রীয় ও সুসংহত সংগঠনের উপর দায়িত্ব দেয়াকে যুক্তিযুক্ত মনে করে। এভাবে মানুষ বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা নিয়ে রাষ্ট্র গঠন করে। রাজনৈতিক সচেতনতার উপর জোর দিয়ে কেলসন (Kelson) বলেন, “The need for order and security is an ever present factor; man knows instinctively that he can develop the best of which he is capable only by some form of political organisation. সুতরাং রাজনৈতিক চেতনার ফলে মানুষ রাষ্ট্রের প্রয়োজন অনুভব করে। কালের বিবর্তনে যে নতুন ও উন্নত শাসনব্যবস্থা তৈরি হয়েছে তাও মানুষের রাজনৈতিক চেতনারই ফলশ্রুতি। অধ্যাপক গিলক্রিস্ট (Gilchrist) যথার্থই বলেছেন, “অন্য সকল উপাদান যেমন— রক্তের সম্পর্ক, ধর্ম ইত্যাদির চেয়ে শ্রেষ্ঠ উপাদান হলো রাজনৈতিক চেতনা।“
পরিশেষে বলা যায় যে, রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিক বা বিবর্তনমূলক মতবাদই সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত মতবাদ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেবল এই মতবাদই রাষ্ট্রের উৎপত্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দান করে। কারণ এই মতবাদের মধ্যে অন্যান্য মতবাদের কিছু না কিছু অংশের আভাস পাওয়া যায়। রাষ্ট্রের উৎপত্তির অন্যান্য মতবাদ অসম্পূর্ণ ও অসমাপ্ত। কারণ সেগুলো রাষ্ট্রের উৎপত্তির দু–একটি উপাদানের উপর জোর দেওয়ায় গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। উপরে বর্ণিত উপাদানসমূহের মিথস্ক্রিয়ার ফল হলো রাষ্ট্র। অধ্যাপক গার্নার (Garner) যথার্থই বলেছেন, “রাষ্ট্র বিধাতার সৃষ্ট। প্রতিষ্ঠান নয়, সুচিন্তিত পরিকল্পনার ফল নয়। এটি স্বাভাবিক বিবর্তনের ফলে জন্মলাভ করেছে।“