প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার বৈশিষ্ট্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার কতগুলো বৈশিষ্ট্য রয়েছে। নিম্নে আলোচনা করা হল:
১. নীতিবাদী রাষ্ট্রচিন্তা
নীতিবাদী রাষ্ট্রচিন্তা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। পাশ্চাত্যের অনেক পন্ডিত মনে করেন যে, প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা যতটা না রাজনৈতিক তার চেয়ে অধিক হলো নৈতিক প্রকৃতির। রাজনীতি শব্দটি ব্যবচ্ছেদ করলেই দেখা যায় যে, রাজনীতি নীতির রাজা। অর্থাৎ নীতিও রাষ্ট্র পরিচালনাকে প্রাচ্যে আলাদা করা হয়নি। সেটা প্রাচীন ভারতের মনুসংহিতা, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এবং ইসলামের প্রতিটি কাজে নৈতিকতার বিধান কায়েমের নির্দেশের মধ্যে পায়।
- ভারতীয় রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের ও নৈতিকতার গভীর যোগসূত্র রয়েছে।
- প্রাচীন চীনের রাষ্ট্রদর্শনে নৈতিকতার সুস্পষ্ট প্রাধান্য লক্ষ করা যায়।
- মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্র দার্শনিকগণ রাষ্ট্র চিন্তা আলোচনায় ইসলামের নৈতিক শিক্ষাগুলোকে রাষ্ট্র প্রতিফলনের ওপর জোর দিয়েছেন।
২. ন্যায় বিচার ধারণার প্রাধান্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় ন্যায় বিচার ধারণা প্লেটোর ধারণা থেকে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে তৃতীয় অধিকরণে রাজাকে আইনে কার্যকর করার জন্য এবং বিচার ব্যবস্থায় মাধ্যমে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য উপদেশ দিচ্ছেন। ন্যায়বিচারকে কৌটিল্যের রাষ্ট্র দর্শনের ভিত্তি বলা হয়। কনফুসিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনে ন্যায়বিচার এবং ন্যায়পরায়ন সরকারের ধারণা একটি অন্যতম বিষয়। ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থার একটি কেন্দ্রীয় বিষয় হলো আসল বা ন্যায়বিচার। আর এর আলোকেই মুসলিম দার্শনিকগণ ইসলামের ভিত্তি হিসেবে ন্যায়বিচার ধারণার যথাযথ বাস্তবায়নে তাঁদের রাষ্ট্রদর্শনের যৌক্তিক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন।
৩. আদর্শবাদের প্রাধান্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে আদর্শবাদের প্রাধান্য লক্ষ করা যায়। প্রাচীন চীনের কনফুসীয় রাজনৈতিক চিন্তাধারায় নৈতিক আদর্শবাদের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। প্রাচীন ভারতের কৌটিল্যের রাষ্ট্রচিন্তা ব্যাপকভাবে বাস্তব বাদের ওপর উঠতে পারেনি। এমনকি এই আধুনিক যুগেও মহাত্মা গান্ধীর রাষ্ট্রদর্শন ও ধর্মীয় ভাবদর্শিক আবেগ থেকে মুক্ত নয়। মধ্যযুগে মুসলিম রাষ্ট্রচিন্তা বিদদের রাষ্ট্রদর্শনকে অনেক পাশ্চাত্য পন্ডিত ইসলামি ভাবাদর্শের সম্প্রসারিত রূপ বলে আখ্যায়িত করেছেন। মুসলিম রাষ্ট্র দার্শনিকগণ ইসলামি আদর্শবাদের সঙ্গে গ্রিক রাষ্ট্রদর্শনের সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেছেন।
আরও পড়ুন: এরিস্টটলকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের জনক বলা হয় কেন? রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর অবদান
৪. ধর্মের প্রাধান্য
ধর্ম সম্ভবত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় স্থান দখল করে আছে। কনফুসীয় দর্শন প্রাচীন চীনে রাজনৈতিক জীবনে যেমন প্রাধান্য বিস্তার করেছিল পরবর্তীতে তা সমাজ জীবনে ধর্মীয় নীতি হিসেবে প্রভাব বিস্তার করেছিল। তাত্তবাদের ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। কৌটিল্যের রাষ্ট্রচিন্তায় বাস্তব অবস্থার চিত্র ও যুক্তিবাদিতা থাকলেও রাষ্ট্রের আদর্শ ও নৈতিক ধারণাবলির ক্ষেত্রে তিনি হিন্দু ধর্মের প্রাধান্যকে অস্বীকার করেনি। মহাত্মা গান্ধীর সর্বোদয় এবং সত্যাগ্রহ সবই ধর্ম উদ্ভুত চিন্তা। মুসলিম রাষ্ট্র দর্শনের মূল পবিত্র আল – কোরআন। পবিত্র কোরআনে ঘোষিত “ইন্নি জায়িলুন ফিল আরদ্বি খলিফা” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি প্রেরণ করব।মহান আল্লাহর এই প্রত্যাদিষ্ট সত্য তত্ত্বের ধারণাই সব মুসলিম রাষ্ট্র দার্শনিকদের মধ্যেই দেখা যায়। আল – ফারাবী জগৎ ও মানুষের মধ্যকার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে দেখাবার চেষ্টা করেছেন অধিবিদ্যা ও রাষ্ট্রদর্শনের সম্বন্ধের মধ্য দিয়ে।
৫. অভিজ্ঞতাবাদী
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় নৈতিকতা ও আদর্শবাদের প্রাধান্য থাকলেও অভিজ্ঞতাবাদী বিশ্লেষণ পদ্ধতির ব্যবস্থাও দৃশ্যমান। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য সে অর্থশাস্ত্র রচনা করেছেন তার প্রধান উপাদান তার রাষ্ট্রশাসনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। সে কারণে তিনি সরকার কাঠামোর সুসংহত ধারণা উপস্থাপন করতে পেরেছেন। কনফুসীয় দর্শনেও অভিজ্ঞতাবাদের প্রভাব দৃশ্যমান। মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্র দার্শনিক নিজামুল মূলক তুসীর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় ধর্মীয় নৈতিকতাবোধের সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদের সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়।
৬. মানবতাবাদী
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় মানবতাবাদের অনেক উপাদান লক্ষ করা যায়। প্রাচীন চীনে কনফুসীয় রাষ্ট্র দর্শনকে অনেকে পরিপূর্ণ মানবতাবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। কনফুসীয় দর্শনে ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কৌটিল্যের রাষ্ট্র দর্শনেও মানবতার সুর ধ্বনিত হয়। মধ্যযুগের মুসলিম দার্শনিকদের রাষ্ট্রদর্শনে ইসলামের সার্বজনীন মানবতাবোধের প্রতিফলন দেখা যায়। তাকাওয়া বা আল্লাহ ভীতিসহ নৈতিক গুণাবলিকে খলিফা বা রাষ্ট্র প্রধান হওয়ার এক মাত্র সূচক হিসেবে চিহ্নিত করণের মধ্যে মানবতাবাদ এবং কল্যাণকামী রাষ্ট্র ধারণার প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। আধুনিক কালে ভারতের এম. এন. বায় এক বিজ্ঞান ভিত্তিক বলিষ্ঠ মানবতাবাদী দর্শন গড়ে তোলেন যা “Radical Humanism” নামে পরিচিত।
৭. ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে গ্রিক দর্শনের সমন্বয়ের প্রবণতা
মধ্যযুগের প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তা ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত। ইসলামের মূল স্পিরিট বুকে ধারণ করে তারা প্লেটো, এরিস্টটলের বইগুলোর নতুন নতুন ব্যাখ্যা আবিষ্কার করেন। তাঁদের রাষ্ট্র দর্শন পর্যালোচনা করলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে ইসলামি ধর্মতত্ত্বের সঙ্গে গ্রিক দর্শনের সমন্বয়ের প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আল – ফারাবির দর্শনে প্লেটোর ব্যক্তি ও রাষ্ট্র সংক্রান্ত ধারণাই লাভ করে এক নবতর রূপে। ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের এই সম্বন্ধের আলোকেই তিনি উদঘাটন করেছেন মানুষ ও জগতের সম্বন্ধকে।
৮. শাসনব্যবস্থা হিসেবে রাজতান্ত্রিক ধারণার প্রাধান্য
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় কল্যাণকামী রাজার ধারণার মাধ্যমে মূলত রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ধারণার স্বীকৃতি লাভ করে। তাই ইউরোপীয় ভ্রমণকারীদের লেখায় প্রাচ্য একনায়ক তান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা নামে পরিচিতি লাভ করে। কনফুসিয়াস রাজতন্ত্রকেই সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজার ভূমিকাকে রাজতান্ত্রিক পিতৃয়তা ধারণার মাধ্যমে প্রকাশ করেন। কৌটিল্যও কল্যাণকামী রাজার ধারণার মাধ্যমে তাঁর রাষ্ট্রদর্শনের বিকাশ সাধন করেন। মধ্যযুগের মুসলিম রাষ্ট্র দার্শনিকগণ আল্লাহর প্রতিনিধি ভিত্তিক খেলাফত ব্যবস্থার কথা বললেও প্রতিষ্ঠিত খলিফা বা সরকারের বিরুদ্ধাচারণকে নিরুৎসাহিত করেছেন যা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজতান্ত্রিক ধরণের।
৯. সুশাসন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ
সাধারণভাবে পাশ্চাত্য লেখকদের লেখায় দেখা যাবে প্রাচ্যের এক নায়ক শাসক বা রাজাদের স্বেচ্ছাচারিতা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে প্রাচ্যের রাজনৈতিক বর্তমান কালের বহুল আলোচিত সুশাসন ধারণা প্রচলিত ছিল। তা কনফুসিয়াস থেকে শুধু করে মহাত্মা গান্ধী এমনকি বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত। কনফুসিয়াস সুশাসন নিশ্চিত করতে রাজাকে সম্ভব সব রকমের ব্যবস্থা গ্রহণে উপদেশ দিয়েছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রকে বিভিন্ন অধ্যায়ে সুশাসন নিশ্চিতকরণে রাজাকে বিভিন্ন উপদেশ বিধৃত হয়েছে। হযরত উমর (রাঃ) এর সুশাসন দ্বারা উদ্বুদ্ধ মুসলিম রাষ্ট্রদার্শনিকগণ তাঁদের লেখনিতে যে কোন ধরনের শাসন ব্যবস্থায় সুশাসন ধারণার উপর জোর দিয়েছেন।
১০. রক্ষণশীলতা
রক্ষণশীলতাকে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা যায়। কৌটিল্য কনফুসিয়াস, মহাত্মা গান্ধী এবং মুসলিম দার্শনিকগণ কোন বৈপ্লবিক রাষ্ট্রদর্শন উপস্থাপন করেননি বা বিদ্যমান সমাজব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথাও বলেনি। কনফুসিয়াস সমাজব্যবস্থার সীমিত পরিবর্তনকে সমর্থন করলেও আমূল পরিবর্তনের ধারণাকে সমর্থন করেননি। কৌটিল্য তৎকালীন প্রচলিত বর্ণ বৈষম্য ভিত্তিক সমাজব্যবস্থার সংরক্ষণের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন।
১১. জনকল্যাণকামিতা
প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তায় জনকল্যাণকামী দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠে। প্রাচীন ভারতের মনুর মতোই কৌটিল্য রাষ্ট্রের উৎপত্তিকে ইশ্বরিক ধারণার মাধ্যমে এবং চরম রাজা ধারণার পরিবর্তে জনকল্যাণকামী রাজা এর ধারণা ব্যক্ত করেছেন। চীনের কনফুসিয়াস ব্যক্তির অধিকারকে সর্বোচ্চ অধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন। আধুনিক যুগে M.N. Roy “রেডিক্যাল হিউম্যনিজম” নামের যে বিজ্ঞানভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শন গড়ে তোলেন তা রূপ লাভ করে র্যাডিক্যাল ডেমোক্রেসিতে।
১২. শান্তি বাণী ঘোষণা
শান্তিময় পরিস্থিতি বজায় রাখা এবং শান্তি সম্পর্কে আলোচনা করা প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সমাজে তথা রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা, ইসলামি রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার বাস্তবায়নে জিহাদের গুরুত্ব, সেই সাথে বিশ্বকে অসঙ্গত যুদ্ধ থেকে মুক্ত রাখার ক্ষেত্রে ইসলামের সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্বকে শান্তিময় আবাসস্থল হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার রয়েছে সুস্পষ্ট নীতি ও নির্দেশনা।
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রাচ্যের রাষ্ট্র চিন্তার বৈশিষ্ট্য গুলো সীমাবদ্ধ রাখা যাবেনা। আরো অনেক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। প্রাচ্যের রাষ্ট্রচিন্তার ঐতিহাসিক বিকাশ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রবণতা পুষ্ট হয়ে প্রাচ্য গড়ে উঠেছে বিভিন্ন মৌলিক রাষ্ট্রদর্শনের এক সমৃদ্ধ সম্ভার।