পেশাদারিত্ব মূলক সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্যসমূহ
নিম্নে সামরিক বাহিনীর পেশাদারিত্ব মূলক বৈশিষ্ট্য গুলো তুলে ধরা হল:
১. দক্ষতা
একটি দেশের সামরিক বাহিনীর তাদের নির্দিষ্ট বিষয়ে দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ জ্ঞান থাকা আবশ্যক।বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে আধুনিককালে সংযুক্ত হয়েছে নানা প্রকার বৈজ্ঞানিক কৌশল ও সমরাস্ত্রের ব্যবহার। Harold lasswell –এর মতে পেশাদারিত্ব সেনাবাহিনীর কাজ হচ্ছে সশস্ত্রযুদ্ধে সফলতা অর্জন করা। তাদের নির্দিষ্ট কিছু কর্তব্য রয়েছে।
ক. সামরিক বাহিনীকে সুসজ্জিতভাবে সংগঠিত করা এবং প্রশিক্ষণ দেয়া।
খ. কার্যক্রমের পরিচালনা করা।
গ. যুদ্ধ ছাড়াও বিভিন্ন অভিযানে নির্দেশ দেয়া।
সামরিক বাহিনীতে দেশের সর্বোচ্চ মেধাসম্পন্ন যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ করা হয়। সামরিক সংগঠন প্রশিক্ষনের মাধ্যমে তাদের আরো যোগ্য ও দক্ষ করে তোলে। ফলে তারা নিজেদের পেশায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দক্ষতা বা বিশেষজ্ঞতা মনোভাব হল পেশাদারিত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট। পেশাদারিত্বের কারণে সেনা সদস্যদের মধ্যে নিজেদের পেশার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। তারা রাজনীতি বা বেসামরিক ক্রিয়াকলাপ নয় বরং রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা বজায় রাখাকে অগ্রাধিকার দেয়। সার্বিক অর্থে পেশাদারি সেনাবাহিনীর দক্ষতা এমন যে, সময় ও অবস্থানের পরিবর্তন ইহার অস্থিত্বকে প্রভাবিত করতে পারেনা। ফলে তাদের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের প্রবণতা থাকে না।
২. দায়িত্বশীলতা
সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। উদাহরণ স্বরূপ- একজন ডাক্তারের প্রাথমিক দায়িত্ব যেমন: রোগীর চিকিৎসা করা, তেমনি সামরিক অফিসারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের আনুগত্য প্রদর্শন। Huntington বলেন, রাষ্ট্রের আইনগত বেসামরিক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছাও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করাই হচ্ছে একজন উচ্চমাত্রার পেশাদারি মনোভাব সম্পন্ন সেনাকর্মকর্তার দায়িত্ব। আর তাই অভ্যন্তরীণ শাসনকার্য বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা সেনাবাহিনীর কাজ নয়। তাই আমরা বলতে পারি দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে সচেতন থাকায় পেশাদারিত্ব মনোভাব সামরিক অভ্যুত্থানকে হ্রাস করে।
আরও পড়ুন: সামরিক পেশাদারিত্ব কি? – আলোচনা কর
৩. বেসামরিক প্রাধান্যের নীতি
পেশাদার সেনাবাহিনী বেসামরিক শক্তি দ্বারা পরিচালিত হয়। এরা বেসামরিক কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে স্ব স্ব কার্য সম্পাদন করবে। অর্থাৎ বেসামরিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকবে। ফলে সামরিক অভ্যুত্থান হ্রাস পাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
৪. আমলাতান্ত্রিকতা
Max Waber আমলাতন্ত্রকে নির্দেশ করেছেন রাজনীতি নিরপেক্ষ একটি প্রতিষ্ঠানরূপে। যেহেতু সেনাবাহিনী একটি আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান সেহেতু ইহা রাজনীতি নিরপেক্ষ হওয়া উচিত। আমলাতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী সামরিক অফিসারগণ ঠিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তার আদেশ পালন করে থাকে।
৫. সুনির্দিষ্ট সীমারেখা
সেনাবাহিনীর ক্ষমতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের ক্ষেত্রে সামরিক – বেসামরিক সম্পর্কের সুনির্দিষ্ট সীমারেখা রয়েছে। পেশাদার অফিসাররা সাধারণত এই সীমারেখা অতিক্রম করার চেষ্টা করেনা। অর্থাৎ বেসামরিক সরকার সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেনা। এবং একইভাবে সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে হস্তক্ষেপ করেনা। এর ফলে দেশে সামরিক হস্তক্ষেপের প্রবণতা হ্রাস পায়।
৬. নিরপেক্ষতা
পেশাদার সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। এটি একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে যে সরকার ক্ষমতাসীন হয় সেই সরকারের আদেশ পালন করে থাকে। এজন্য সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হয়না।
৭. সামরিক বাহিনীর বস্তুনিষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ
পেশাদার সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে বিদ্যমান। এদের উপর বেসামরিক কর্তৃপক্ষের Subjective Control বজায় থাকেনা। S.E. Finer বলেন, সামরিক কর্মকর্তারা তখনই পেশাদারি হতে পারে যখন তাদের আনুগত্য থাকবে শুধুমাত্র সামরিক নীতি ও আদর্শের প্রতি। আর তাদের নিয়ন্ত্রনের পুরোটাই থাকবে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে। ফলে সামরিক হস্তক্ষেপ হ্রাস পেতে পারে।
৮. নন-সবিলাইজেশন
পেশাদার সামরিক বাহিনীরা কারনে অকারনে সৈন্য সমাবেশ ঘটায়না। তারা জনগণকে বিশেষ কোন মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করেনা।
৯. Corporateness
সামরিক বাহিনীর সকল সদস্যের লক্ষ্য এক ও অভিন্ন। একতাই বল এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে পেশাদারী সামরিক বাহিনীর সকল সদস্য একযোগে কাজ করে। সেনাবাহিনীর প্রত্যেক সদস্য প্রত্যেকের কর্তব্যকে নিজের কর্তব্য বলে মনে করে যা অন্যান্য যাবতীয় সংগঠন হতে স্বতন্ত্র এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মহিমন্ডিত হয়ে উঠেছে। তাই তারা তাদের গৌরব ও মাহিমন্ডিত থেকে টিকিয়ে রাখার জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকে।
১০. অসংগঠিত সেনাবাহিনী
পেশাদার সেনাবাহিনী বিভিন্ন এলাকা থেকে নিযুক্ত বিধায় এরা সংগঠিত হতে পারেনা। ফলে তারা ক্ষমতা দখলের চেষ্টাও করেনা। যদিও অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর মধ্যে মতৈক্য থাকা সত্বেও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। কিন্তু সেনাবাহিনী পেশাদার হলে তা করতে পারেনা। যেমন: ভারতের সেনাবাহিনী।
১১. অভিন্নতা
একটি আধুনিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয়। পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার উপর তারা নির্ভরশীল। কোন সামরিক সদস্যের পক্ষে এককভাবে অভ্যুত্থান ঘটানো সম্ভব হয়না। কাজেই তাদের কাজের মধ্যে যদি Similarity না থাকে তবে অভ্যুত্থান ঘটার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। সকলের কাজ একই রকম থাকায় সামরিক হস্তক্ষেপ হ্রাস পায়।
১২. জনস্বার্থমূলক সংগঠন
পেশাদার সেনাবাহিনী সরকারের নির্দেশানুযায়ী দেশের অভ্যন্তরীণ জাতীয় দুরযোগ মুহূর্তে দুঃখ ও দুর্গত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। সেনাবাহিনী রাজনৈতিক সরকারের আহবানে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সন্ত্রাসদমন বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি জনকল্যাণমূলক কাজে অংশগ্রহণ করে থাকে তবে এরূপ অংশগ্রহণ তাদেরকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার দ্বার উন্মোচিত করেনা।
১৩. যৌথ মনোভাব
সামরিক বাহিনী একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তাদের মধ্যে যৌথ মনোভাব কাজ করে। স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা সচেতন। স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয় বাধাগ্রস্ত না হলে সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থান করেনা। তাই পেশাদারি মনোভাব তাদের মধ্যে স্বার্থ সম্পর্কে যৌথ মনোভাব সৃষ্টি করে যা তাদের অভ্যুত্থান থেকে বিরত রাখে।
১৪. দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা সৃষ্টি
পেশাদারিত্বের ফলে সামরিক বাহিনীর দৃষ্টিভঙ্গি রাজনীতিবিদদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পৃথক হয় ফলে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের লাভের ব্যাপারে আগ্রহী হয়না। পেশাদারিত্বের ফলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রাজনৈতিক অজ্ঞতা থেকে যায়। এ কারনেও তারা ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী না।
১৫. কেন্দ্রীভূত সংগঠন
সামরিক বাহিনী একটি কেন্দ্রীভূত সংগঠন। এখানে যে আদেশ-নির্দেশ দেয়া হয় সেগুলো কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করা হয়। কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের প্রতি সদস্যের প্রশ্নাতীত আনুগত্য থাকে। আর এই আনুগত্যই হলো পেশাদারিত্ব। তাদের নিয়ন্ত্রণ পুরোটাই থাকবে বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে। এই নিয়ন্ত্রন রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপর প্রবণতা হ্রাস করতে পারে।
১৬. সামরিক আইন ও আদর্শ
সামরিক বাহিনীকে এমন সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তোলা হয় যে, তাদের মধ্যে বিভিন্ন সমস্যা ও আইনগত জটিলতা দেখা দিলে তার সুসমাধান হবে Cantonment এর ভিতর প্রতিষ্ঠিত স্বতন্ত্র Marshall Court –এ। এমনকি কোন সামরিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি আইন ভঙ্গ ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি কোন কাজ করে থাকে তবে বিচার হবে বিশেষ আদালত Marshall Court –এ, তাদেরকে সাধারণত আদালতে আনা হবেনা।