উন্নয়নশীল দেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ আধুনিক কালের রাজনীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, উন্নয়নশীল দেশসমূহে বেসামরিক সরকারের পতন ও সামরিক বাহিনী কর্তৃক রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নেয়া নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহের রাজনীতি মূলত; সামরিক বাহিনীই নিয়ন্ত্রন করছে। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ বছরেরও কম সময়ের ব্যবধানে বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ ১৫ বছর সামরিক শাসক দ্বারা দেশ শাসিত হয়েছে। সামরিক শাসকরা ক্ষমতা গ্রহণের পর জনগণের নিকট নিজেদের শাসন গ্রহণযোগ্য করার জন্য এবং নিজেদেরকে সঠিক প্রমাণ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ যেমন- নির্বাচন অনুষ্ঠান, নতুন রাজনৈতিক দল গঠন ইত্যাদি গ্রহণ করে, যেগুলোকে একত্রে বেসামরিকীকরণ নীতি বলা হয়। এই সময়ে তারা বিভিন্ন বেসামরিকীকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
বেসামরিকীকরণ নীতি কি ?
বেসামরিকীকরণ নীতি বলতে বোঝায়, রাজনৈতিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং রাষ্ট্রীয় সকল গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অবারিত ক্ষমতা বেসামরিক নেতৃত্ব তথা জনপ্রতিনিধিদের হাতে প্রত্যার্পন। অর্থাৎ, সামরিক বাহিনী কেবল ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন করবে না বরং নীতি নির্ধারন সহ সকল কাজ সামরিক বাহিনীর চাপ ও প্রভাব হতে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকবে।
জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার পটভূমি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক সামরিক অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। এই অভ্যুত্থানের পর মেজর জিয়াউর রহমান সামরিক বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এর নেতৃত্বে পুনরায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে। এই সময় সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানকে বন্দী করা হয় এবং খালেদ মোশাররফ এর দল দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করে। দেশে চরম বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এমতাবস্থায় ৭ নভেম্বর কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বে খালেদ মোশাররফ এর বিরুদ্ধে সেনা বিপ্লব ঘটে এবং জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। এই বিপ্লবে খালেদ মোশাররফ নিহত হন। মুক্ত হওয়ার পর জিয়া সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। এই সময় দেশে সামরিক আইন জারি থাকে। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সায়েম পদত্যাগ করলে জিয়া নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। একইসাথে তিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদেও বহাল থাকেন।
আরও পড়ুন: সামরিক-বেসামরিক সম্পর্ক কি? সামরিক-বেসামরিক সম্পর্কের প্রকারভেদ
জিয়াউর রহমানের বেসামরিকীকরণ নীতি
নিম্নে জিয়াউর রহমানের বেসামরিকীকরণ নীতিগুলো আলোচনা করা হলো-
১. রাজনৈতিক তৎপরতা পুনর্বহাল
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এর পর থেকে সামরিক আইন বলে সকল রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়ার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে “রাজনৈতিক দলবিধি” নামে একটি আদেশ জারি করেন। এতে শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক দল গঠন ও তৎপরতার অনুমতি দেওয়া হয়।
২. ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন
জিয়াউর রহমান তার শাসনকে বৈধ করার জন্য ক্ষমতায় আসার কিছুকাল পরেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন করেন। ১৯৭৭ সালের ১৩ জানুয়ারী ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়, যার মাধ্যমে দেশে রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাবার শুভ সূচনা ঘটে।
৩. সংবিধান সংশোধন
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ২৭ এপ্রিল এক গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার মাধ্যমে সংবিধানের সংশোধন করেন। এখানে, ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাস এবং বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীস সংযোজন করা হয়।
৪. ১৯ দফা কর্মসূচী
জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯ টি ধারা সম্মিলিত একটি কর্মসূচী ঘোষণা করেন যা ১৯ দফা কর্মসূচী নামে পরিচিত।
৫. গণভোট
জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার বৈধতা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে সার্বজনীন ভোটাধিকার এর ভিত্তিতে ১৯৭৭ সালের ৩০ মে একটি গণভোটের আয়োজন করেন। গণভোটে প্রশ্ন করা হয়,”রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও তার নীতি ও কর্মসূচীর প্রতি আপনার আস্থা আছে কি?” সরকারী হিসেব মতে ৮৮% ভোটার এই ভোট প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেন এবং এর মধ্যে ৯৯.৮৮% পড়ে ”হ্যা” সূচক।
৬. পৌরসভা নির্বাচন
১৯৭৭ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৭৭ টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় নির্বাচন কমিশনের তত্ত্বাবধানে। ২৫ সেপ্টেম্বর একই ব্যবস্থায় ঢাকা পৌর কর্পোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে ৭৭ জন চেয়ারম্যান ও ৮৬ জন কমিশনার নির্বাচন করা হয়।
৭. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
গণভোটের পর বগুড়া ও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পর পর দুটি সেনা বিদ্রোহ ঘটে। এই অবস্থায় জিয়াউর রহমান তার ক্ষমতার সমর্থন ধরে রাখার জন্য ১৯৭৮ সালের জুন মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে ঘোষণা দেন। সেই প্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে জেনারেল জিয়া ও ওসমানীর মাঝে তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতা হয়। জিয়া ৭৬.৭৩% ভোটে জয়যুক্ত হন যেখানে ওসমানী পান ২১.৭% ভোট।
৮. রাজনৈতিক দলবিধি বাতিল ও দলীয় কার্যক্রম শুরু
১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই জারী করা হয় রাজনৈতিক দলবিধি। ১৯৭৮ সালের ৩ জুন এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের কিছুকাল পূর্বে ২২ এপ্রিল, ১৯৭৮ সালে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের উপর আরোপিত সকল নিষেধাজ্ঞা এক ঘোষণাবলে তুলে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গিয়ে ১৯৭৮ সালের ১৭ নভেম্বর রাজনৈতিক দলবিধি পুরোপুরি বাতিল করা হয়।
৯. দল গঠন প্রক্রিয়া
জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে জিয়া ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) গঠন করেন, যেখানে সাত্তার থাকেন নেতৃত্বে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রাক্কালে জিয়ার জাগদল অন্যান্য দলের সমন্বয়ে জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট গঠন করে। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের আগস্ট মাসে ফ্রন্ট ভেঙ্গে দিয়ে ১লা সেপ্টেম্বর নিজের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP) গঠন করেন ।
১০. মন্ত্রিপরিষদ গঠন
১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর জিয়া ৩০ জুন একটি মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। এখানে ২৮ জন মন্ত্রী ও ২ জন প্রতিমন্ত্রি ছিল। এদের ১৮ জন গণতান্ত্রিক দল, ৪ জন ন্যাশনাল আওয়ামী (ভাসানী) পার্টি, ২ জন ইউ.পি.পি, ৩ জন মুসলিম লীগ ও একজন তফসিলি ফেডারেশনের ছিলেন।
১১. জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারী সামরিক আইনের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সকল প্রধান রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ৩০ টি দল নির্বাচনে অংশ নেয় এবং ভোটার অংশ নেয় ৫১%, জিয়ার দল BNP ৩০০ টির মধ্যে ২০৭ টি আসন লাভ করে। আওয়ামীলীগ পায় ৩৯ টি, মুসলিম লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ যৌথভাবে ২০ টি, জাসদ ৮ টি, স্বতন্ত্র্য ১৬ টি এবং বাকী ১০ টি আসন পায় অন্যান্য দল।
১২. সামরিক আইন প্রত্যাহার
১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল নবনির্বাচিত জাতীয় সংসদ অধিবেশনে সংবিধানের ৫ম সংশোধনী দ্বারা সামরিক শাসন আমলের সকল কর্মকাণ্ড এবং ঐ সময়কালে জারিকৃত ঘোষণা ও আদেশ বৈধ ঘোষণা করা হয়। পরবর্তীতে ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
১৩. পল্লী এলাকায় নতুন প্রতিষ্ঠান গঠন
গ্রামাঞ্চলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি জনসমর্থনের ভীত মজবুত করার লক্ষ্যে ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান গ্রাম সরকার গঠন করেন। গ্রাম সরকারকে সাহায্য করার জন্য ১৫০ জন সদস্য সম্বলিত গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করেন।