বর্তমান বিশ্বের দেশগুলো কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত। এ ধরনের রাষ্ট্রগুলো জনকল্যানার্থে কাজ করে থাকে।এসব রাষ্ট্রের সরকার যাতে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে না পারে এবং জনগণের অধিকার ক্ষুণ্ন না করতে পারে তার জন্য নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব ঘটেছে। “ন্যায়পাল” এর ধারণাটিরও উৎপত্তি ঘটেছে সরকারের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা হ্রাসের উদ্দেশ্যে। পৃথিবীর অনেক দেশে ন্যায়পালের ধারণার ন্যায় অনুরূপ ধারণার উৎপত্তি ঘটেছে। বিভিন্ন দেশে সরকারের স্বেচ্ছাচারী ভূমিকা হ্রাস করার জন্য ”ন্যায়পাল”, ”লোকপাল”, ”পার্লামেন্টারী কমিশনার” ইত্যাদি ব্যবস্থা বিদ্যমান। মূলত, আধুনিক কল্যানমূলক রাষ্ট্রে প্রশাসনের স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার, সুশাসন, জবাবদিহিতা এবং কার্যকর প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রগুলো ন্যায়পালের ধারণার উৎপত্তি ঘটেছে। বর্তমান বিশ্বে অনেক রাষ্ট্রই ন্যায়পালের ধারণাটি জনপ্রিয় ধারণা হিসেবে গ্রহণ করেছে। রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতির কারণে ন্যায়পাল ব্যবস্থাকে বাস্তবায়ন করা দুরূহ হলেও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সাথে জড়িত ন্যায়পালের ধারণাটি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
ন্যায়পাল
ন্যায়পাল এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হলো “Ombudsman” । এটির উদ্ভব ঘটেছে সুইডেন থেকে। সুইডিশ শব্দ Ombuds অর্থ হল “Officer”, “Spokesman” (মুখপাত্র), “Representative” (প্রতিনিধি) ইত্যাদি। ন্যায়পাল হল এমন এক ব্যাক্তি যিনি অন্যের কথা বলেন কিংবা অন্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
অন্যকথায়, ন্যায়পাল হলেন এমন একজন ব্যক্তি বা প্রতিনিধি যিনি নির্বাহী ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের উত্থাপিত অভিযোগসমূহ তদন্তপূর্বক সমাধানের সুপারিশ করতে পারেন।এটি একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুন: সংবিধানের প্রস্তাবনা কি? বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনা কয়টি ও কি কি?
ন্যায়পাল এর সংজ্ঞা
ন্যায়পালকে বিভিন্ন জনে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। যেমন-
- Bernard Frank –এর মতে,
“Ombudsman” means an office established by constitution or statute headed by an independent, high level public official who is responsible to the legislature, who receives complaints from aggrieved persons against government agencies, officials and employees or who acts on his own motion, and has power to investigate, recommend corrective action and issue reports”.
Frank Bernard,The Ombudsman and Human Rights”, 1986, P-11
- Oxford Dictionary অনুযায়ী,
“Ombudsman is an official appointed by a government to investigate and report on complains made by citizens against public authorities”.
- Professor Rowat তাঁর গ্রন্থ “The Ombudsman: Citizen’s Defender”- এ বলেন,
“Ombudsman is an independent and politically neutral officer of the legislature who receives and investigates complains from the public against administrative action and who has the power to criticize and publicize but not the reverse such action.”
Rowat, 1986, 1X
- Professor Garner বলেন,
“Ombudsman is an officer of parliament, having as his primary function, the duty of acting as an agent for parliament, for the purpose of safeguarding citizens against abuse or misuse of administrative power by the executive.”
Garner, 1981, P-92
সুতরাং বলা যায়, ন্যায়পাল হল আধুনিক কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের সরকার ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সৃষ্ট এক আইনগত ব্যবস্থা, যা নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে সরকারী কর্মচারী, সশস্ত্র বাহিনী ও বিচারকগণ দেশের আইন সঠিকভাবে পালন করছে কিনা; নাগরিকগণ তাদের দ্বারা কোথাও হয়রানির শিকার হচ্ছে কিনা ইত্যাদি ব্যাপারে অভিযোগ তদন্তকারী দপ্তর হিসেবে কাজ করে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের ন্যায়পাল ও ভারতের লোকপালের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা
ন্যায়পালের উৎপত্তি
ন্যায়পাল ধারণাটির জন্মভূমি হল সুইডেন। সুইডেনের রাজা চার্লস দ্বিতীয় ১৭১৩ সালে সরকারী কর্মকর্তাদের কাজের ধরন তদারকির জন্য রাজার প্রতিনিধি হিসেবে “Chancellor of justice” নামক একটি পদ সৃষ্টি করেন। মূলত, ইসলামের আইনগত ব্যবস্থার বিধান দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি এরূপ পদের সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে ১৮০৯ সালে গৃহীত সুইডিশ সংবিধানে এ পদটিকে হলে বা তার উপর কোন অন্যায়/অবিচার হলে ন্যায়পালের নিকট অভিযোগ করতে পারে। ন্যায়পাল অভিযোগ তদন্ত করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নির্দেশ দেন। ১৯১৫ সালে সুইডেন ”মিলিটারী ন্যায়পাল” নামক আলাদা পদ সৃষ্টি করে। ১৯৬৮ সালে এই ২ ধরনের ন্যায়পালের বিভাগকে একত্রিত করা হয়। বর্তমানে সুইডেনে ২ জন ডেপুটি ন্যায়পাল সহ মোট ৪ জন ন্যায়পাল রয়েছে যারা সরকারের সকল বিভাগের উপর অভিযোগ তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ হিসেবে কাজ করে।
সুইডেনের অনুসরণে অনেক দেশই ন্যায়পালের ধারণাটি গ্রহণ করে অনুরূপ পদ সৃষ্টি করে। ১৯৫৫ সালে ডেনমার্ক, ১৯৬১ সালে নিউজিল্যান্ড ন্যায়পাল পদ সৃষ্টি করে। ১৯৬৩ সালে নরওয়ে ন্যায়পাল নিয়োগ দেয়। ব্রিটেন “ন্যায়পাল” নামটি গ্রহণ না করলেও একই রকম পদ সৃষ্টি করে যার নাম “সংসদীয় কমিশনার”। ১৯৬৭ সালে The Parliamentary Commissioner Act পাশের মাধ্যমে ব্রিটেনে অনুরূপ পদ সৃষ্টি করা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় ১৯৭৩ সালে এ পদ সৃষ্টি করা হয়। ভারতে “লোকপাল” নামে অনুরূপ পদ সৃষ্টির প্রস্তাব ও আলোচনা হয়েছে, তবে তা এখনো কার্যকর হয়নি।