তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সমস্যা
মাগুরা উপনির্বাচনের পরে ১৯৯৪-৯৬ সময়কালে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুললে বিএনপি প্রথমে সে দাবিতে সাড়া না দিয়ে পরবর্তীতে ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে একটি কোন রকমের নির্বাচন করে স্বল্পায়ুর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একতরফা ভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করে। তবে এ সাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী নির্বাচন করতে গিয়ে বেশ কিছু অসুবিধা পরিলক্ষিত হলেও রাজনৈতিক দলগুলো সেসব সমস্যা নিরসনে মনোযোগ দেয়নি। পরবর্তী সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নামধারী সেনা সমর্থিত এক অসাংবিধানিক জরুরি সরকার তিন মাসের রেওয়াজীয় বেষ্টনী ভেঙ্গে দুই বছর ক্ষমতায় থেকে, সাংবিধানিক নির্দেশনা না মেনে ব্যাপক হারে গ্রেফতার করে সমাজ ও রাজনীতি লন্ডভন্ড করে এ সরকারের অধিকতর কালিমা লেপন করে। সতর্কতার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলোর কর্মকান্ড পরীক্ষার পর সাধারণ বিবেচনায় এ অস্থায়ী সরকার ব্যবস্থার যে সমস্যাগুলো ধরা পড়ে নিম্নে তা তুলে ধরা হল-
☞বিচার বিভাগে রাজনীতির অশুভ প্রভাব
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিদের প্রাধান্য দেওয়ায় নির্বাচনের সময় কে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি হবেন সে সম্পর্কে ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক অঙ্ক কষার ফলে বিচার বিভাগে রাজনীতির অশুভ প্রভাব পড়ে।
☞রাষ্ট্রীয় দৈনন্দিন রুটিন কাজ
রাষ্ট্রীয় দৈনন্দিন রুটিন কাজ করার রেওয়াজীয় /সাংবিধানিক নির্দেশনা ভেঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো নীতি নির্ধারণী কাজে জড়িত হয়। যেমন- বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের শিক্ষা সংস্কার কমিটি গঠন এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমানের নবম-দশম শ্রেণীতে ধর্ম বিষয় পড়ানো হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রদান।
☞সুস্পষ্ট নির্দেশনার অভাব
একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকায় এবং এ ব্যবস্থা কতকাল চলবে সে বিষয়েও তেমন কোন লিখিত নির্দেশনা না থাকা।
☞ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর উদাসীনতা
আলোচ্য অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদকাল সম্পর্কে কোন উল্লেখ না থাকায় রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচন কমিশনের উন্নতি ঘটিয়ে এ ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার প্রতি ক্ষমতাসীন সরকারগুলোর মনোযোগ না দেয়া। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা এবং এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টাদের সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়গুলো সুস্পষ্ট না করা।
উল্লেখিত সমস্যাগুলোর সমাধান করে নতুন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্দলীয় চরিত্র বজায় রেখে এর নতুন রূপরেখা নির্মান করে এর পক্ষে সর্বসম্মত সমর্থন নিয়ে সাংবিধানিক ভিত্তি দিয়ে এ সমস্যার নিরসন করা সম্ভব ছিল। কিন্তু নির্বাচিত সরকারগুলো সে উদ্যোগ না নেওয়ায় এ ব্যবস্থার সমস্যাগুলো নিরসন করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন: তত্ত্বাবধায়ক সরকার কি? বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তনের কারণ
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের যৌক্তিকতা
মহাজোট সরকার ২০০৯ সালে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংস্কারের পরিবর্তে এ ব্যবস্থা বাতিল করার যে উদ্যোগ গ্রহণ করে, সে বিষয়টি ভাল করে বুঝতে হলে এ ব্যবস্থার অতীত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নেওয়া দরকার। নিম্নে তা তুলে ধরা হল-
☞তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অতীত ইতিহাস
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে সামরিক শাসন বিরোধী সম্মিলিত আন্দোলনে সামরিক শাসক অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হতে রাজী হলে এই সরকারের অধীনে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি জয় পেয়ে সরকার গঠন করে। তখন বিরোধীদল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন দাবি করে। সে দাবি আদায়ের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলে। বিএনপি এ দাবি মানতে রাজি না হওয়ায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এহেন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি ১৯৯৫ সালে নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে সংসদ ভেঙ্গে দিলে নির্বাচন কমিশন ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করে। বিরোধীদলগুলো এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে একে প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়ায় নির্বাচনটিতে ব্যাপকভাবে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সপ্তম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে যথাক্রমে হাসিনা সরকার ও চারদলীয় জোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি, তেমনি এ অগণতান্ত্রিক ও অনির্বাচিত সরকারের কবল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা সহ বিরাজিত সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতেও উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। নবম সংসদ নির্বাচনে বিশাল জয় নিয়ে সরকার গঠন করার পর মহাজোট সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে প্রদত্ত উচ্চ আদালতের রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশের একাংশ ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের আইন পাশ করে, যদিও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার সুপারিশ ছিলনা।
☞তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পরিকল্পনা
মহাজোট সরকার অবশ্য ক্ষমতাসীন হবার পর থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরিকল্পনা করে। প্রশ্ন ওঠে, যে আওয়ামী লীগ সরকার মধ্য-১৯৯০ দশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম করে, সে দলই আবার ২০০৯ সালে ওই আওয়ামী লীগের আন্দোলনের ফসল ও জননেত্রী শেখ হাসিনার ”ব্রেন চাইল্ড” তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করতে তৎপর হলো কেন? ওই সময়ে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য আমির হোসেন আমু এ প্রশ্নের এভাবে জবাব দেন,” তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি ভালো, তবে ২০০৬ সালের বিভিন্ন পর্বে প্রমাণিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টারাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন এবং নিরপেক্ষতা ভঙ্গ করেছেন। সরকার দলের এসব নেতা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব মনে করেন।
☞বিরোধী দলগুলোর তত্ত্বাবধায়কের প্রতি সমর্থন
বিএনপি, সরকারের শরিক ওয়ার্কাস পার্টি ও জাসদসহ বাম ঘরানার দলসমূহ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিলের পদক্ষেপের সমর্থন করেনি। এ ব্যাপারে সরকারের শরিক রাশেদ খান মেনন এবং হাসানুল হক ইনুর ভূমিকা স্বচ্ছ ছিল না। এরা প্রথম দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে বক্তব্য বিবৃতি দিলেও এ ব্যবস্থা নাকচ করে আনীত পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাসের সময় এর পক্ষে ভোট দেন। আবার বিল পাসের আগে বাইরে এর বিরুদ্ধে শো-ডাউন করে হালকা প্রতিবাদ দেখাতে চেষ্টা করেন।
☞সরকারি দলের এ ব্যবস্থা বাতিলের যৌক্তিকতা
সরকার দলীয় নেতৃবৃন্দ ও মন্ত্রীগণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলের পক্ষে বলেন। অথচ যে কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে পারষ্পরিক অবিশ্বাস, নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা, সাংঘর্ষিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি, পরাজিত পক্ষের নির্বাচনি ফলাফল মেনে না নেওয়ার সংস্কৃতি প্রভৃতি জায়গাগুলোতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি না দেখিয়েই এ ব্যবস্থা বাতিল করার পক্ষে যুক্তি দেন।
☞নাগরিক সমাজের মতামত
সাধারণ নাগরিক সমাজ মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করার মত পরিবেশ সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো তৈরি করতে পারেনি। কাজেই স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বার্থে দলীয় সরকারের পরিবর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই নির্বাচন হওয়া উচিত।
☞অভিনব রায়
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের ফুলবেঞ্চ প্রদত্ত রায়টির চরিত্র, প্রকৃতি ও বাস্তবতা অভিনব ও স্ববিরোধী প্রকৃতির। কারণ এ রায়ে একদিকে যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবৈধ ও বেআইনি বলা হয়, আবার অন্যদিকে দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তার স্বার্থে আরও দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়। বিরোধীদলকে নাখোশ করলেও আলোচ্য সরকারি দলকে ব্যাপক সুবিধা প্রদান করে। এ রকম রায়ের ফলে সরকার সুবিধাজনক অবস্থান থেকে বলতে পারে, আদালতের রায়কে আমাদের সম্মান করতে হবে; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার আর কোন সুযোগ নেই।
☞সংবিধান (পঞ্চদশ সংশোধন) বিল-২০১১
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর লক্ষ্যে সংসদ নেত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবক্রমে কার্যপ্রণালী বিধির ২৬৬ বিধি অনুযায়ী ২০১০ সালের ২১ জুলাই সংসদে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরিকে চেয়ারপার্সন ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে কো-চেয়ারপার্সন করে গঠিত ১৫ সদস্যবিশিষ্ট সরকারদলীয় সংসদীয় কমিটি ১০ মাসে ২৭ টি বৈঠক করে ৫১ দফা সুপারিশ তৈরি করার প্রক্রিয়ার প্রথমদিকে কমিটির সদস্যরা তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহাল রাখার পক্ষে থাকলেও শেষ দিকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এ ব্যবস্থা বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রধান বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ও পরামর্শ ছাড়াই বিশেষ কমিটি ২০১১ সালের ৫ জুন তারিখে এর সুপারিশ চুড়ান্ত করে ৮ জুন তা সংসদে উপস্থাপন করে। বিলটি জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়।
☞সাংবিধানিক অসঙ্গতি
সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে এককভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্তটি গুরত্বপূর্ণ, কিন্তু সরকার সংবিধানে আরও অনেক সংশোধনী এনে সার্বিকভাবে সংবিধানের চেহারাই পাল্টে দেয়। সবাইকে খুশি করার চিন্তা নিয়ে সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটি নতুন সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ রেখে বিএনপিকে, ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ইসলাম রেখে সরকারের শরিক জাতীয় পার্টিকে, “ধর্মভিত্তিক রাজনীতি” রেখে জামায়াতসহ ইসলামপন্থী দলগুলোকে, “সমাজতন্ত্র” রেখে বামপন্থীদেরকে, ”ধর্মনিরপেক্ষতা” রেখে অমুসলিমদেরকে এবং ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলে আওয়ামী লীগকে খুশি করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। কিন্তু বাস্তবে সংশোধনী পাস হবার পর কাউকেও উল্লসিত হতে দেখা যায়নি।