মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান রচয়িতাগণ ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার্থে মন্টেস্কুর ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতি দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছিলেন। ঔপনিবেশিক শাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতায় জর্জরিত তৎকালীন নেতৃবৃন্দ অনুভব করেছিলেন যে, সরকারের সকল ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা সংস্থার হাতে ন্যস্ত হলে স্বৈরাচার জন্ম নিতে বাধ্য। তাই তারা সরকারের তিনটি বিভাগের ক্ষমতা একে অপরের হস্তক্ষেপ মুক্ত রাখার জন্য নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি প্রয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ হন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে মার্কিন কংগ্রেস, রাষ্ট্রপতি ও সুপ্রিম কোর্ট একে অপরের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করছে এবং নিজেদের ক্রিয়াকলাপের ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে।
নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির কঠোর প্রয়োগ ঘটলে সরকারের বিভাগগুলোর মধ্যে অকাম্য ও অশুভ প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে। প্রতিটি বিভাগের মধ্যে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার এবং স্বৈরাচারী হওয়ার একটা প্রবণতা দেখা দিবে। এ আশঙ্কায় সংবিধান রচয়িতাগণ সরকারের বিভাগগুলোর স্বৈরাচারী প্রবণতা রোধের জন্য পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য বজায় এবং পারস্পরিক সমঝোতা ও সহযোগিতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এক অনন্য ও অসাধারণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন, যা পরবর্তীতে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি নামে পরিচিত হয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতি
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ১(৩) ধারায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির কথা বলা হয়েছে। মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রয়োগ ও এর কার্যকারিতা নিম্নে আলোচনা করা হল-
১. আইন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইন বা কংগ্রেসের কার্যাবলির উপর নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রয়োগ করা হয়েছে। যদিও মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও কংগ্রেস দু’টি স্বতন্ত্র সংস্থা এবং সম্পূর্ণ পৃথকভাবে নির্বাচিত, তবুও উভয়ের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা মার্কিন সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
মার্কিন রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারে এবং যে কোন প্রস্তাব কংগ্রেসে পেশ করতে পারেন। তবে কংগ্রেস এ প্রস্তাব গ্রহণ বা বর্জন কিংবা সংশোধন অথবা মূল প্রস্তাবের আমূল পরিবর্তন করতে পারে। এক্ষেত্রে কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সীমিত করে থাকে। আবার কংগ্রেস প্রণীত আইনের উপর রাষ্ট্রপতি ভেটো প্রয়োগ করতে পারেন। তবে পরবর্তীতে ঐ বিলটি আবার যদি কংগ্রেসের দুই-তৃতীয়াংশ সদসস্যের ভোটে পাস হয়, তাহলে এক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বিলে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য।
আরও পড়ুন: ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর
২. শাসন বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ
মার্কিন শাসন বিভাগের কার্যাবলিও পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য নীতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। মার্কিন রাষ্ট্রপতি শাসন বিভাগের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি কংগ্রেস ও সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নন। রাষ্ট্রপতির চার বছরের কার্যকাল শেষ হওয়ার আগেই কংগ্রেস ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে তাকে পদচ্যুত করতে পারেন।
মার্কিন রাষ্ট্রপতির হাতে ব্যাপক নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সন্ধি বা চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা ন্যস্ত থাকলেও এগুলো সিনেটের অনুমোদন ছাড়া কার্যকরী হয় না। উদাহরণস্বরূপ, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি উড্রো উইলসন ভার্সাই চুক্তি এবং জাতিসংঘের সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করলেও সিনেট তা অনুমোদন করে নি। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘে যোগ দিতে পারে নি।
৩. বিচার বিভাগের উপর নিয়ন্ত্রণ
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগও অন্য দু’টি বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত নয়। সিনেটের অনুমোদন সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের নিযুক্ত করেন। তবে মূলত এ নিয়োগ রাজনৈতিক বিচার বিবেচনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আবার কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সংখ্যা নির্ধারণ করেতে পারে। তাছাড়া কংগ্রেস সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিষয়ক ক্ষমতা, জাতীয় আদালতসমূহের এক্তিয়ার, বিভিন্ন অধঃস্তন ও জাতীয় আদালত গঠন ও বিলোপ প্রভৃতি বিষয়ে ক্ষমতা ভোগ করেন। সর্বোপরি বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্ত রোধ এবং বিধিনিষেধের অপসারণের উদ্দেশ্যে কংগ্রেস আইন প্রণয়ন করতে পারে।