ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ কেবিনেট ব্যবস্থার মধ্যমণি। তাকে কেবিনেট স্থাপত্যের প্রধান প্রস্তর নামে আখ্যায়িত করা হয়। কেবিনেট ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার কেন্দ্র এবং প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের কেন্দ্র। কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে এবং কেবিনেটের সভাপতি হিসেবে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী শাসনব্যবস্থায় এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানের অধিকারী।
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও কার্যাবলির গুরুত্ব সম্পর্কে Dr. Jennings বলেছেন, “তিনি যেন একটি সূর্য, যার চারদিকে রাজনৈতিক উপগ্রহসমূহ আবর্তিত হয়।” তাই বলা যায় যে, ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এত ক্ষমতায় ভূষিত যে, পৃথিবীর কোন শাসনতান্ত্রিক শাসন এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টও এত ক্ষমতার অধিকারী নয়। নিম্নে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করা হল-
১. সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর স্থান অদ্বিতীয়। তার ব্যক্তিত্বকে ঘিরে রাজনৈতিক দলটি কর্মক্ষেত্র রচনা করে। দলীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর উপর ন্যস্ত। দলের মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তিনি সেসব বিরোধের নিষ্পত্তি করে দলীয় সংহতি অক্ষুণ্ণ রাখেন। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিত্ব, দূরদর্শীতা ও সুদৃঢ় নেতৃত্বের উপরই দলীয় সাফল্য নির্ভরশীল।
২. কেবিনেটের নেতা হিসেবে
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের নেতা। তাকে কেন্দ্র করেই কেবিনেট গঠিত হয়, কেবিনেট কার্যপরিচালনা করে এবং এর পতন হলেও তাকে কেন্দ্র করেই হয়। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রীর উপর প্রভুত্ব করেন। তার সম্বন্ধে বলা হয় যে, “তিনি সমকক্ষদের মধ্যে প্রধান কিন্তু স্বৈরাচারী নন।”
৩. কমন্স সভার নেতা
কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাকেই রাজা বা রানী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। কমন্স সভার নেতা হিসেবে পার্লামেন্ট বা কমন্স সভার অধিবেশন কখন বসবে এবং কত সময়ের জন্য বসবে তাও তিনি নির্ধারণ করে থাকেন। গুরুত্বপূর্ণ কোন বিল পাস করানোর দায়িত্ব তাকেই বহন করতে হয়।
আরও পড়ুন: ব্রিটিশ কমন্স সভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী
৪. মন্ত্রিসভার মধ্যমণি
প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট ও মন্ত্রিসভার মধ্যমণি। কেবিনেটের উত্থান ও পতন প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। তিনিই মন্ত্রীদের ও কেবিনেট সদস্যদের মনোনীত করেন। প্রয়োজনবোধে তিনিই আবার রাজা বা রানীকে পরামর্শ দিয়ে যে কোন মন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে পারেন।
৫. নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা
তত্ত্বগতভাবে নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষমতা রাজা বা রানীর হাতে ন্যস্ত থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ছাড়া রাজা বা রানী নিয়োগ প্রদান করতে পারেন না। সুতরাং, উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা, বিচারপতি, রাষ্ট্রদূত প্রভৃতি কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
৬. রাজা বা রানীর পরামর্শদাতা
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রাজা বা রানীর প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যেমন- কমন্স সভা ভেঙে দেওয়া, লর্ড সভার সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা, প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত করা, রাজনৈতিক বা অন্য প্রকারের বিশেষ কার্যের জন্য সম্মানসূচক উপাধি বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীই রাজা বা রানীকে পরামর্শ প্রদান করে থাকেন।
৭. আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার সম্মতি ছাড়া কোন আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদিত হয় না। বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত বিবৃতি প্রধানমন্ত্রীই দিয়ে থাকেন। আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্ব করেন।
৮. শাসন বিভাগের প্রধান
কাগজে কলমে ব্রিটেনের রাজা বা রানী শাসন বিভাগের প্রধান হলেও বাস্তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীই শাসন বিভাগের সর্বাধিনায়ক। শাসনব্যবস্থার প্রতিটি বিভাগের প্রতি তার প্রখর দৃষ্টি রাখতে হয়। তিনি সকল দপ্তরের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে থাকেন। সকল দপ্তরে সরকারি নীতি প্রয়োগ হচ্ছে কি না সেদিকে তিনি খেয়াল রাখেন।
৯. আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা
ব্রিটেনের আেইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এজন্য বলা হয়, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেবল সে দেশের শাসন বিভাগরেই প্রধান নন, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তার নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত। কমন্স সভার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে তিনি সহজেই পার্লামেন্টকে দিয়ে নিজের পছন্দমতো আইন পাস করে নিতে পারেন।
১০. প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত
ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হলেন রাজা বা রানী। তবে কার্যক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুসারেই রাজা বা রানীর এ ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়। যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে কোন সংকটকালীন সময়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন প্রধানমন্ত্রী। যেমন- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রধানমন্ত্রী উইনস্টোন চার্চিল প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করেন।
১১. বিরোধীদলের সাথে সংযোগ স্থাপন
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কেবল নিজ দলের সাথে সংযোগ রক্ষা করে চলেন না, তিনি বিরোধীদলের সাথেও সহযোগিতা ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করেন। জাতির সংকটময় মুহূর্তে তিনি বিরোধীদলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে সংকট উত্তরণের চেষ্টা করেন। যেমন- ফকল্যান্ড যুদ্ধে মার্গারেট থেচার বিরোধীদলের মদদ যোগতে বেশ সচেষ্ট ছিলেন।
১২. ডোমিনিয়ন দেশসমূহের সাথে সম্পর্ক
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডোমিনিয়ন দেশসমূহের প্রধানমন্ত্রীদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন এবং প্রয়োজনবোধে ডোমিনিয়ন পার্লামেন্টের সভায় সভাপতিত্ব করেন।
১৩. জরুরি অবস্থায়
জরুরি অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অপ্রতিহতভাবে বৃদ্ধি পায়। সে সময় তিনি জরুরি ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকল্পে কেবিনেটকে পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে পারেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ জারি করতে পারেন। যেমন- ডিজরেইলী প্রথম সুয়েজ খালের শেয়ার কিনে পরে কেবিনেটকে অবগত করেন।
1 comment
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গঠন ও কার্যাবলী আলোচনা করো।
Comments are closed.