বিশ্বের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্রিটেনে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা বিদ্যমান। এর উচ্চকক্ষের নাম লর্ড সভা এবং নিম্নকক্ষের নাম কমন্স সভা বা House of Commons । এ কমন্স সভাই ব্রিটেনের প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়। কেননা, কমন্স সভার সদস্যগণ জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। তাদেরকে সাধারণত পার্লামেন্ট সদস্য বলে অভিহিত করা হয়।
কমন্স সভার ক্ষমতা ও কার্যাবলী
কমন্স সভাবে পার্লামেন্টের নিম্ন কক্ষ বলা হলেও এটি লর্ড সভার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী এবং এর কার্যাবলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি জন প্রতিনিধিমূলক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা ভোগ করে থাকে। নিম্নে কমন্স সভা এর ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা করা হল-
১. নির্বাচন সংক্রান্ত ক্ষমতা
ব্রিটিশ কমন্স সভার প্রথম কাজ হল সদস্যদের মধ্য হতে একজনকে স্পিকার বা সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা। নির্বাচিত হওয়ার পর স্পিকার নির্দলীয় হয়ে পড়েন এবং কমন্স সভায় নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন।
২. আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত কাজ ও ক্ষমতা
তত্ত্বগতভাবে বলতে গেলে House of Commons মূলত একটি আইন প্রণয়নকারী সংস্থা। সকল প্রধান আইনের বিলই প্রথমে House of Commons এ উত্থাপন করা হয়। House of Commons এ উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা গৃহীত না হলে কোন বিলই আইনে পরিণত হতে পারে না। কমন্স সভায় গৃহীত বিল লর্ড সভা বাতিল করতে পারে না।
৩. সরকার গঠনের ক্ষমতা
প্রত্যেকে সাধারণ নির্বাচনের পর কমন্স সভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বা নেত্রীকেই রাজা বা রানী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। বিদ্যমান সাংবিধানিক রীতিনীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী কমন্স সভার সদস্য বা সদস্যা হবেন। কমন্স সভায় আস্থা হারালে সরকারকে পদত্যাগ করতে হয়। তাই বলা যায় যে, কমন্স সভাই সরকার গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সম্পর্কিত বিষয়
ব্রিটেনে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং আইন ও প্রথাগত বিধানের মধ্যে পার্থক্য
ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলো কি? এটা কি গণতন্ত্রের পরিপন্থি?
৪. অর্থ বিল সংক্রান্ত ক্ষমতা
অর্থ বিলও প্রথমে কমন্স সভায় উত্থাপিত হয়ে থাকে। রাজা বা রানীর পূর্ব সম্মতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী কমন্স সভায় অর্থবিল উত্থাপন করেন। কমন্স সভা কর্তৃক অর্থ বিল গৃহীত হওয়ার পর ঐ বিল লর্ড সভার অনুমোদনের জন্য প্রেরিত হয়। লর্ড সভা কোন অর্থ বিল প্রত্যাখ্যান করতে পারে না।
৫. নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ
নাগরিকদের অধিকার সংরক্ষণ করা কমন্স সভার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কমন্স সভা একমাত্র প্রতিনিধিত্বমূলক কক্ষ বিধায় এর মাধ্যমে জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়ে থাকে।
৬. শাসন বিভাগের তদারকি
কমন্স সভা দেশের শাসনব্যবস্থা তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কমন্স সভা শুধু সরকার গঠন ও সমর্থন করে না, বরং সরকারের কাজকর্মের উপর সতর্ক দৃষ্টি রেখে এর সমালোচনাও করে থাকে। কমন্স সভার সদস্যরা মন্ত্রীদের স্ব-স্ব দফতরের বিষয়াদি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। এরূপ প্রশ্নোত্তরকালে সরকারের কোন দোষত্রুটি ধরা পড়লে তার প্রতিবিধানকল্পে কমন্স সভা প্রয়োজনবোধে কমিশন বা কমিটি গঠন করতে পারেন।
৭. মন্ত্রিসভাকে নিয়ন্ত্রণ
ব্রিটেনের পার্লামেন্টারি শাসনব্যবস্থার অন্যতম মৌলিক নীতি হল কমন্স সভার নিকট মন্ত্রিপরিষদের দায়িত্বশীলতা। সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য মন্ত্রিগণকে ব্যক্তিগতভাবে এবং যৌথভাবে কমন্স সভার নিকট দায়ী থাকতে হয়। তাই কমন্স সভায় আস্থা হারালে মন্ত্রিপরিষদকে পদত্যাগ করতে হয়। প্রশ্ন জিজ্ঞাসা, বিতর্ক অনুষ্ঠান, নিন্দাসূচক প্রস্তাব উত্থাপন, অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন প্রভৃতির মাধ্যমে কমন্স সভা মন্ত্রিসভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
৮. সংবাদ ও তথ্য সরবরাহ
সরকারি কার্যাবলি সম্পর্কে সভার সদস্যরা মন্ত্রিদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। মন্ত্রীরা কমন্স সভার এসব প্রশ্নের জবাবে যেসব তথ্য সরবরাহ করেন তা নির্ভরযোগ্য সূত্রে সংগৃহীত হয়ে সংবাদপত্র, বেতার , টেলিভিশন প্রভৃতির মাধ্যমে জনগণের নিকট পৌঁছায়। এর ফলে জনসাধারণ সরকারের কার্যকলাপ সম্পর্কে সঠিক সংবাদ ও তথ্য জানার সুযোগ পায়।
৯. জনমত গঠন সংক্রান্ত কাজ
House of Commons এর বিতর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কমন্স সভায় বিরোধীদল সরকারের ব্যর্থতা ও বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে বক্তৃতা করে। এসব সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনগণের কাছে প্রচারিত হয়। অপরদিকে, সরকারি দলও সমালোচনারমুখে তাদের নীতির সপক্ষে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। এগুলো জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
১০. সরকারি আয়ব্যয় নিয়ন্ত্রণ
প্রত্যেক আর্থিক বছরের শেষে রাজা বা রানীর পূর্বানুমতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী কমন্স সভায় পরবর্তী আর্থিক বছরের সম্ভাব্য আয়ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে প্রস্তাব পেশ করেন। এ প্রস্তাব বাজেট প্রস্তাব নামে পরিচিত। এ বাজেটের মাধ্যমেই সরকারের আর্থিক নীতি প্রতিফলিত হয়। কমন্স সভার অনুমোদন ছাড়া সরকার কর ধার্য, করের হার পরিবর্তন, কর বিলোপ, বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারেন না।
১১. সংযোগমূলক কাজ
ব্রিটেনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় কমন্স সভা সরকার ও জনগণের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা পালন করে। কমন্স সভার সদস্যরা প্রত্যেকের নির্বাচনী এলাকার অভাব-অভিযোগ ও সমস্যাদি সভায় পেশ করেন। এর ফলে জনগণের সমস্যাগুলো সম্পর্কে সরকার অবহিত হন এবং সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
১২. সংবিধান সংশোধন
ব্রিটেনের সংবিধান অলিখিত এবং নমনীয়। সুতরাং, কমন্স সভার উপস্থিতিতে এবং ভোটদানকারী সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থনে যেভাবে কোন সাধারণ বিল অনুমোদিত হয় সে একইভাবে সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন করা যায়।