ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান উৎস হল প্রথাগত বিধান বা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি । বস্তুত এ রীতিনীতির উপরই ইংরেজ জাতির শাসনব্যবস্থার মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটেনের অলিখিত শাসনতন্ত্রের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো ছড়িয়ে আছে। এ রীতিনীতিগুলোকে কেন্দ্র করেই ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থা আবর্তিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলোকে বাদ দিয়ে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার পরিপূর্ণ পরিচয় পাওয়া অসম্ভব। এককথায় শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো হল ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি।
শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি
ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থায় প্রথাগত বিধান বা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি বলতে বুঝায়, সে দেশের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কিত কতকগুলো অলিখিত নিয়ম পদ্ধতি, যা পারস্পরিক বুঝাপড়া ও চুক্তির মধ্যদিয়ে গড়ে উঠেছে এবং যা শাসন পরিচালনা কার্যে ব্যবহৃত সকল স্তরের জনগণ বাধ্যতামূলকভাবে মেনে নিয়েছে।
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রথাগত বিধান সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করেছেন। যেমন-
Prof. A. V. Dicey বলেছেন, “দেশাচার হল রাজা তার অবারিত ক্ষমতা কিভাবে কার্যকর করবেন এর রীতিনীতি নির্ধারণ করার নিয়মাবলি।”
Prof. Ogg বলেছেন, “প্রথাগত বিধান হচ্ছে এমন কতিপয় অভ্যাস বা বুঝাপড়া, যেগুলো সরকারি কর্তৃপক্ষের পারস্পরিক সম্পর্ক এবং ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে।”
অতএব, প্রথাগত বিধান হল কতকগুলো অলিখিত রীতিনীতি, অভ্যাস ও ঐতিহ্যের সমষ্টি, যা আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য নয় অথচ জনগণ সেগুলো নিয়মিতভাবে মেনে চলে।
আরও পড়ুন: ব্রিটেনে রাজতন্ত্র টিকে থাকার কারণগুলো কি? এটা কি গণতন্ত্রের পরিপন্থি?
আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি বা প্রথাগত বিধানের মধ্যে পার্থক্য
আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে কতকগুলো মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সংকীর্ণ অর্থে আইন বলতে বুঝায় সার্বভৌম রাষ্ট্রশক্তি কর্তৃক সুনির্দিষ্টভাবে রচিত ও বিধিবদ্ধ এমন কতকগুলো নিয়মকানুন, যা মানুষের বাহ্যিক ও সামাজিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেগুলো আদালত কর্তৃক গৃহীত, স্বীকৃত ও বলবৎ হয়। আইন সম্পর্কিত এ ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে আইন ও শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মধ্যে কতকগুলো বিশেষ পার্থক্য বিদ্যমান। যথা-
১. উৎসগত পার্থক্য
আইন প্রণয়ন করা হয় কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি প্রণয়ন করা হয় না, ধীরে ধীরে গড়ে উঠে। আইনানুসারে গঠিত আইনসভা কর্তৃক আইন প্রণীত হয়। আইনসভা হল আইনের মূল উৎস। শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো প্রচলিত প্রথাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে। তাই উভয়ের মধ্যে উৎসগত দিক থেকে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান।
২. প্রকৃতিগত পার্থক্য
আইন লিখিত থাকে বলে তা মোটামোটিভাবে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হয়। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো আচার ব্যবহার, প্রথা ইত্যাদির ভিত্তিতে গড়ে উঠে বলে তা অস্পষ্ট ও অনির্দিষ্ট প্রকৃতি সম্পন্ন। তাই বিভিন্ন লোক এগুলোর ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। অন্যদিকে আদালত ছাড়া অন্য কেউ আইনের ব্যাখ্যা করতে পারে না।
৩. গুরুত্বগত পার্থক্য
আইনের মর্যাদা শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির মর্যাদা অপেক্ষা অনেক বেশি। আইন মান্য করা বাধ্যতামূলক কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি মান্য করা বাধ্যতামূলক নয়। আইন আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও রক্ষিত বলে, আইন অমান্য করলে আদালত শাস্তি দানের ব্যবস্থা করতে পারে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিসমূহ আদালত কর্তৃক স্বীকৃত ও রক্ষিত নয় বলে তা অমান্য করলে শাস্তি পেতে হয় না।
৪. পরিবর্তন পদ্ধতির পার্থক্য
আইনের উৎপত্তি ও পরিবর্তন সচেতনভাবে সর্বসমক্ষে এবং অনেক সময় দ্রুত হয়ে থাকে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির উদ্ভব ও পরিবর্তন ধীরে ধীরে এবং সবার অলক্ষ্যে হয়ে থাকে। দেশ-কাল-পাত্র ও সমাজের পরিবর্তনের সাথে সাথে শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতিগুলো জনসাধারণের অগোচরে পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
৫. অস্তিত্বগত পার্থক্য
আইন প্রয়োজনমতো প্রণয়ন করা যায়। এমনকি একটি বিশেষ প্রয়োজনে জরুরি আইন জারি করা যায়। কিন্তু ইচ্ছামতো শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি সৃষ্টি করা যায় না। শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি সুদীর্ঘকাল ধরে ক্রমবিবর্তনের মাধ্যমে গড়ে উঠে।
৬. প্রয়োগগত পার্থক্য
আইন আদলত কর্তৃক বলবৎযোগ্য। আইন অমান্য করলে আইন অমান্যকারীকে আদালতে অভিযুক্ত করা যায় এবং তার শাস্তি হয়। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতি আদালত গ্রাহ্য নয়। এগুলোর পিছনে আদালতে স্বীকৃতি বা সমর্থন থাকে না। তাই আদালত এগুলোকে প্রয়োগও করে না। শাসনতান্ত্রিক রীতিনীতির তুলনায় আইন অনেক বেশি পবিত্র।