কার্ল মার্কস যেসব তত্ত্ব প্রদান করেছেন তার মধ্যে “Class Struggle Theory” বা শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব হচ্ছে সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ। মার্কস মনে করেন, মানবজাতির ইতিহাস তার ক্রমোন্নতিকে স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে। এ সামাজিক ক্রমোন্নয়ন বা সামাজিক বিকাশ শ্রেণীর উদ্ভব এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক দ্বান্দ্বিক সম্পর্কেরই ফলশ্রুতি। সেই খাদ্য সংগ্রহ থেকে আধুনিক সমাজ পর্যন্ত সমাজ বিকাশের প্রতিটি পর্যায়েই দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম বিদ্যমান, যেখানে একটি শ্রেণী আরেকটি শ্রেণীর উপর প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করে।
শ্রেণী এবং শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব
মার্কস এর শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বের অন্যতম আলোচ্যবিষয় হচ্ছে নির্দিষ্ট উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজের মধ্যকার শ্রেণী সম্পর্ক। যদিও মার্কস এর বহু পূর্বে প্রায় ২৫০০ বছর আগে এরিস্টটল প্রথম ‘শ্রেণী’ শব্দটি ব্যবহার করেন, তথাপি শ্রেণী সম্পর্কিত মার্কস এর ধারণা এবং বক্তব্য সুস্পষ্ট।
মার্কস মনে করেন, “শ্রেণী হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বার্থ দ্বারা সমপর্যায়ে উদ্ভূত গোষ্ঠী।” মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীতে মার্কস এই শ্রেণী শব্দটি ব্যবহার করেন। তাঁর মতে, শ্রেণী হচ্ছে উৎপাদন শক্তি এবং উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের মাধ্যমে উদ্ভূত অর্থনৈতিক স্বার্থগোষ্ঠী।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মার্কস এর আলোচনায় শ্রেণী হচ্ছে ‘সামাজিক শ্রেণী’ যা ‘সামাজিক উৎপাদন’ এর সাথে সম্পর্কযুক্ত। সামাজিক উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম্পর্কের বিভিন্নতার কারণে সামাজিক শ্রেণীর উদ্ভব সামাজিক সম্পর্কের দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
মার্কস মনে করেন, শ্রম হচ্ছে উৎপাদনের মূল চালিকাশক্তি। শ্রমিকের শ্রম থেকে প্রাপ্ত উদ্বৃত্ত মালিক আত্মসাৎ করে, আর শ্রমিক তার যথার্থ মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়। এ ব্যাপারে শ্রমিক যখন সচেতন হয়, তখনই দু’য়ের মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং শ্রমিক শ্রেণীসংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
আরও পড়ুন: কার্ল মার্কসের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ তত্ত্বটি আলোচনা কর
শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বের বিশ্লেষণ
বিবদমান শ্রেণীগুলোর মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি হতে বাধ্য, কারণ একটি শ্রেণীর সমৃদ্ধি অপর শ্রেণীর অবনতি ঘটায়। এ পরস্পরবিরোধী শ্রেণীস্বার্থ দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামকে অনিবার্য করে তোলে। আর এই শ্রেণীসংগ্রামের চূড়ান্ত রূপ হচ্ছে সামাজিক বিপ্লব।
মার্কস মনে করেন, সমাজ বিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়েই এ ধরনের পরস্পরবিরোধী দু’টি শ্রেণীর অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। সমাজে বিদ্যমান এ দু’টি শ্রেণী হচ্ছে- শোষক এবং শোষিত শ্রেণী, যারা পরস্পরের বিরুদ্ধে অব্যাহত শ্রেণীসংগ্রামে লিপ্ত।
মার্কস এর মতে, আদিম সাম্যবাদী সমাজে অর্থাৎ মানবসমাজের প্রাথমিক পর্যায়ে কোন উদ্বৃত্ত ছিল না। ব্যক্তিগত সম্পত্তি এর কোন ধারণা সৃষ্টি হয় নি। ফলে সমাজ ছিল শোষণহীন, শ্রেণী দ্বন্দ্বহীন। সাম্য ছিল সমাজের মূলভিত্তি।
আদিম সাম্যবাদী সমাজের বিলুপ্তির পর প্রথম শ্রেণী বিভক্ত সমাজ হচ্ছে দাস সমাজ, যেখানে দাস ও দাস প্রভু দু’টি পরস্পরবিরোধী শ্রেণী গড়ে উঠে। যোদ্ধা এবং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ অন্যান্যদের অবদমিত করে নিজেরা অধিপতিতে পরিণত হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলার মাধ্যমে শোষণকে আরও প্রবল করে। দাসেরা বঞ্চিত এবং শোষিত হয়ে অবশেষে সংঘবদ্ধ বিদ্রোহ করে। ফলে নতুন সমাজ গড়ে উঠে সামন্তসমাজ।
কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজে ভূস্বামী এবং ভূমিদাস এ দু’টি পরস্পরবিরোধী শ্রেণীর সৃষ্টি হয়। এ সামন্তসমাজে মালিকানা ‘মানুষ’ থেকে ‘ভূমি’তে পৌঁছায়। উৎপাদন উপকরণের মালিক সামন্ত প্রভুরা ভূমিদাসদের উপর অবাধ শোষণ চালাতে থাকে। পরবর্তীকালে এ দু’টি শ্রেণীর দ্বন্দ্ব এবং সংগ্রামে গড়ে উঠে নতুন সমাজব্যবস্থা- পুঁজিবাদী সমাজ।
মার্কস এর মতে, “প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনের মাধ্যমে এ পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিকাশ।” পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় বুর্জোয়ারা হচ্ছে সকল উৎপাদন ব্যবস্থার মালিক, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করে। ফলে শোষক শ্রেণী আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে আর শ্রমিক শ্রেণী নিঃস্ব হয়ে সর্বহারা শ্রেণীতে পরিণত হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদন যন্ত্র, উৎপাদিত পণ্য এমনকি শ্রমিক শ্রেণীও বুর্জোয়াদের নিজস্ব সম্পদে পরিণত হয়। এমন অবস্থায় প্রলেতারিয়েতরা শোষণের হাত থেকে মুক্তির আশায় সংঘবদ্ধ হয়ে বিপ্লব গড়ে তোলে। ফলশ্রুতিতে বুর্জোয়া-প্রলেতারিয়েত এর সংঘাতে-সংগ্রামে পুঁজিবাদী সমাজ বিলুপ্ত হয়ে গড়ে উঠে সমাজতান্ত্রিক সমাজ।