টমাস হবস্ তাঁর প্রকৃতির রাজ্য ও মানব প্রকৃতি ধারণার জন্য বিখ্যাত। তিনি ১৫৮৮ সালে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। ইংল্যান্ডের চরম দুর্দিনে শান্তিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকল্পে এবং রাজশক্তির সমর্থনে তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “লেভিয়েথান” রচনা করেন। এ গ্রন্থে অত্যন্ত জোরালো যুক্তির সাহায্যে তিনি তার মতবাদের তত্ত্ব প্রদান করেছেন। নিম্নে মানব প্রকৃতি ও প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে তাঁর ধারণা আলোচনা করা হল-
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে হবসের ধারণা
হবস্ মানব প্রকৃতি সম্পর্কে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক ধারণা পোষণ করেতেন। নিম্নে মানব প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর ধারণা আলোচনা করা হল-
১. মানুষ মূলত জড় পদার্থ
হবস্ মানব প্রকৃতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেছেন যে, মানুষ অন্যান্য জড় বস্তুর ন্যায় একটি পদার্থ। মানবদেহকে তিনি বস্তু এবং মানব মনকে ক্ষয়িঞ্চু পদার্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। মানুষ ও জড়বস্তুর মধ্যে যেটুকু পার্থক্য আছে তা হচ্ছে মানুষের মধ্যে জড়বস্তুর ন্যায় অণুপরমাণু ছাড়াও যুক্তি নামক আর একটি বিশেষ অতিরিক্ত উপাদান কাজ করে। যুক্তির সাহায্যে সে চিন্তাভাবনা করে কাজ করতে চায় বলে তার আচরণে কিছুটা অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা থাকে। অন্যথায় জড় পদার্থের মত আচরণ সম্পর্কে সঠিকভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যেত।
২. কর্মব্যবস্ততা
মানবজীবন সর্বদা কর্মব্যবস্ত। এ কর্মচাঞ্চল্যের শেষ নেই। মৃত্যু পর্যন্ত চলে কর্মব্যস্ততা।
৩. আকাঙ্ক্ষার মূল লক্ষ্য ক্ষমতা
মানব প্রকৃতির আর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো, যদিও সে আকাঙ্ক্ষার দ্বারা পরিচালিত হয় কিন্তু সে তার আকাঙ্ক্ষাকে শুধু বর্তমানের সুখান্বেষণে সীমাবদ্ধ রাখে না। তার আকাঙ্ক্ষার মূল লক্ষ্য হচ্ছে এমন এক ক্ষমতা যার সাহায্যে সে তার ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার পথ সুগম করতে পারে।
আরও পড়ুন: টমাস হবসের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব আলোচনা কর
৪. আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণা
হবসের মতে, যে জিনিস মানুষের অনুভূতিতে অনুকূল সাড়া জাগায় সে জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মে এবং তা লাভ করার জন্য সে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। অপরদিকে, যে বস্তু মানুষের অনুভূতিতে প্রতিকূল সাড়া জাগায় তার প্রতি মানুষের বিতৃষ্ণা জন্মে।
৫. ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী
মানব প্রকৃতি সম্পর্কে হবসের এ ধারণাকে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী বলা চলে। তাঁর মতে, মানুষ সম্পূর্ণভাবে স্বাতন্ত্র্যবাদী। অপরের সর্বস্ব হরণ করে স্বীয় স্বার্থ রক্ষা ও স্বীয় উন্নতি সাধনই তার অন্তর্নিহিত প্রকৃতি।
৬. মানুষ উপযোগবাদী
হবসের মতে, মানুষ সব সময়ই আনন্দ লাভ করতে চায় এবং দুঃখকে এড়াতে চায়। যে জিনিস মানুষের অনুভূতিতে অনুকূল সাড়া জাগায় সে জিনিসের প্রতি মানুষের আকর্ষণ জন্মে এবং তা লাভ করার জন্য সে আকাঙ্ক্ষা করে। আকাঙ্ক্ষিত বস্তু পেলে আনন্দিত হয়, না পেলে দুঃখবোধ করে।
৭. অসীম আকাঙ্ক্ষা
হবসের মতে, মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই। একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলে অপর একটি আকাঙ্ক্ষার উদয় হয়। কোন বস্তু একবার ভোগ করার পর তা ভবিষ্যতেও ভোগ করার স্পৃহা জাগ্রত হয়।
৮. স্বার্থপরতা
হবসের মতে, মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর। তার যাবতীয় কর্মপ্রয়াস, ধ্যানধারণা, আবেগ-অনুভূতি স্বার্থকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়। কাজেই স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলেই মানুষ কষ্ট পায়।
৯. সকল মানুষই প্রায় সমান
হবস মনে করেন যে, মানুষে মানুষ তেমন কোন পার্থক্য নেই। আপাত দৃষ্টিতে পার্থক্য লক্ষ্য করা গেলেও মানুষ একে অপরের প্রায় সমান। যে ব্যক্তি দৈহিক দিক থেকে শক্তিশালী সে হয়ত মনের বুদ্ধি ও জ্ঞানের দিক থেকে দুর্বল। আবার যে ব্যক্তি মনের দিক থেকে সবল সে হয়ত দৈহিক বা বুদ্ধির দিক থেকে দুর্বল।
সুতরাং, মানব প্রকৃতির মূলকথা হচ্ছে, মানুষ স্বার্থপর, লোভী, আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালিপ্সু। হবসের মতে, রাষ্ট্রের জন্মের আগে মানুষের এ স্বার্থপরতা বা অহঙ্কারবোধের মধ্যে অন্যায় অক্যাণকর বলে কিছু ছিল না। যখন থেকে রাষ্ট্রের জন্ম হয় তখন থেকেই এগুলোর নৈতিক, বৈধতা বা অবৈধতার প্রশ্ন দেখা দেয়।
প্রকৃতির রাজ্য সম্পর্কে হবসের ধারণা
মানব প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে হবস তাঁর প্রকৃতির রাজ্যের চিত্র অঙ্কন করেছেন। হবসের প্রকৃতির রাজ্যের ধারণা নিম্নরূপ-
১. ন্যায়-অন্যায়ের স্থান ছিল না
প্রকৃতির রাজ্যে প্রত্যেকেরই শত্রু ছিল। তারা সর্বক্ষণ দ্বন্দ্ব-কলহ, খুন-খারাবি ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল। এরকম ভয়াবহ যুদ্ধাবস্থা সেখানে সব সময়ই বিরাজ করত। এরূপ ভয়ঙ্কর অবস্থায় মানুষের বুদ্ধি বিবেকের চর্চা, যুক্তিকে কাজে লাগানোর অবকাশ সেখানে মোটেই ছিল না। কাজেই ন্যায়-অন্যায়বোধ তখন মানুষের মধ্যে ঘটে নি। হবসের মতে, যেখানে সাধারণ ক্ষমতা নেই, সেখানে আইন নেই, সেখানে বিচারও নেই। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধীন সভ্য সমাজেই একমাত্র ন্যায়-অন্যায়বোধ থাকতে পারে। প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ বন্য পশুদের মত জীবনযাপন করত।
২. সমাজবিহীন অসভ্য অবস্থা
রাষ্ট্র সৃষ্টির পূর্বে মানুষ যে অবস্থায় বাস করত তাকে বলা হতো প্রকৃতির রাজ্য। মানব প্রকৃতির সাথে সঙ্গতি রেখেই হবস তাঁর প্রকৃতির রাজ্যের বর্ণনা দিয়েছেন। প্রকৃতির রাজ্যে কোন সমাজব্যবস্থা বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। কাজেই নিয়মশৃঙ্খলার অভাবে মানুষ সেখানে অসভ্য ও বর্বর জীবনযাপন করত। জীবনের নিশ্চয়তা বা সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের কোন ব্যবস্থা সেখানে ছিল না। প্রত্যেক মানুষই যেহেতু স্বার্থপর ও লোভী, সেহেতু প্রত্যেকেই নিজ স্বার্থ ও লোভ চরিতার্থ করতেই ব্যস্ত ছিল।
৩. মানুষের জীবন ছিল নিষ্ঠুর, নিঃসঙ্গ ও সংক্ষিপ্ত
হবস্ বর্ণিত প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জীবন ছিল পশুতুল্য। তখন কেবল সমাজ বা রাজনৈতিক সংগঠন ছিল না। নিয়মশৃঙ্খলার অভাবে মানুষ সেখানে অসভ্য ও বর্বরের ন্যায় জীবনযাপন করত। নিশ্চয়তাবিহীন জীবনে মানুষ একে অপরকে সন্দেহ করত বলে নিঃসঙ্গ, নিষ্ঠুর জীবনযাপন করত এবং তাদের জীবন ছিল সংক্ষিপ্ত।