১৮৮৫ সালের শেষের দিকে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নব যুগের সূচনা করে। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে কংগ্রেসের ভূমিকা ছিল অনন্য। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের সময় পর্যন্ত কংগ্রেস ছিল ভারতবাসীর প্রধান জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠান। ভারতের প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষ কংগ্রেসের পতাকাতলে সমবেত হয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের লক্ষ্যে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। সুতরাং বলা যায়, ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতহাস হলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাস।
জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পটভূমি
ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিশেষ প্রসার ঘটে এবং এরই ফলশ্রুতিতে জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হয়। এ সময় ভারতীয়দের মধ্যে ইংরেজী শিক্ষার প্রসার এবং একটা শিক্ষিত ও সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হয়। এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী ক্রমশঃ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। ভারতে প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন এবং স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি বিষয়ে তাঁরা সচেতন হয়ে উঠেন। কিন্তু এ ধরনের রাজনৈতিক আদর্শ কার্যকর করার জন্য উপযোগী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান সে সময় ভারতে ছিল না।
১৮৭৫ সালে বাংলার কয়েকজন চিন্তাশীল রাজনীতিবিদ ভারতীয়দের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘ইন্ডিয়া লীগ’ নামে একটি রাজনৈতিক সংস্থা গঠন করেছিলেন। কিন্তু এ সংস্থা স্থায়ী হয়নি। তবে স্বল্পকালীন স্থায়ী হলেও ভারতের জাতীয় জাগরণের ইতিহাসে এর বিশেষ অবদান ছিল।
ইন্ডিয়া লীগের পর ১৮৭৬ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় কর্তৃক গঠিত হয় ‘ভারত সভা’ (Indian Association)। ভারতীয়দের স্বার্থ রক্ষা এবং ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশ সাধনে এ সভার অবদান ছিল অপরিসীম। সুরেন্দ্রনাথের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ভারত সভা ভারতীয় সিভিল সার্ভিস (I.C.S.) পরীক্ষার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ সময় ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের উচ্চতর চাকুরী থেকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার্থীদের উর্ধ্বতন বরসসীমা ২১ বছর থেকে কমিয়ে ১৯ বছর করেন। এতে ভারতে সর্বত্র এক গভীর অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার আন্দোলনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সিভল সার্ভিস পরীক্ষার বিধিগুলো পরিবর্তন করতে বাধ্য হন।
আরও পড়ুন: আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ – কি ছিল কারণ?
১৮৭৮ সালে বড়লাট লিটন দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য Vernacular Press Act এবং ভারতবাসীকে নিরস্ত্র করার জন্য Arm Act পাশ করেন। ভারত সভা এ দু’টি আইনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
এ সময় ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের মধ্যে জাতিগত বৈষম্যও প্রকট আকার ধারণ করে। ফলে ইংরেজ ও ভারতীয়দের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম অবনতি ঘটে। ১৮৮৩ সালে ইলবার্ট বিলকে কেন্দ্র করে বিদেশী শাসনের প্রতি ভারতীয়দের ঘৃণার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। এ বিলের উদ্দেশ্য ছিল বিচার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এ যাবৎ ভারতীয় ও ইউরোপীয়দের মধ্যে যে বৈষম্য ছিল তা দূর করা। এ বিলের মাধ্যমে ভারতীয় বিচারকদের ইংরেজ বিচারকগণের সম-মর্যাদা ও সম-ক্ষমতা দানের প্রস্তাব করা হয়। এ বিলের বিরুদ্ধে ইংরেজরা তুমুল আন্দোলন শুরু করলে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারত সভাও প্রত্যুত্তরে প্রতি-আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার ইউরোপীয়দের কাছে নতিস্বীকার করতে বাধ্য হন। এসব ঘটনাবলীর মাধ্যমে সচেতন শিক্ষিত ভারতবাসী এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, স্থায়ী সংগঠন ছাড়া ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সম্ভব নয়। ঐতিহাসিক অনিল শীল ইলবার্ট বিল সংক্রান্ত আন্দোলনকে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পূর্বাভাস (Dress Rehearsal) বলে মন্তব্য করেছেন।
১৮৮৩ সালে কলকাতায় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এক আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ হতে বহু বিশিষ্ট নেতা এই প্রদর্শনী উপলক্ষে কলকাতায় জমায়েত হতে পারেন এ কথা বিবেচনা করে সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় কলকাতায় এক জাতীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। ভারতের বিভিন্ন অংশ হতে শতাধিক প্রতিনিধি এ সম্মেলনে যোগ দেন। এ সভায় শিল্প ও কারিগরি শিক্ষা, বৃহত্তর কর্মসংস্থান, বিচার ব্যবস্থায় পৃথকীকরণ, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠন প্রভৃতি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা হয়। এ সম্মেলন খুবই সফল হয়। ১৮৮৫ সালে ডিসেম্বর মাসে কলকাতায় জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন আহ্বান করা হয়। এ সভায় আলোচ্য বিষয় ছিল সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার সংস্কার এবং একযোগে ইংল্যান্ড ও ভারতে পরীক্ষা গ্রহণ, অস্ত্র আইন রহিতকরণ, বিচার ও শাসন বিভাগের পৃথকীকরণ এবং সামরিক ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগের ব্যয়ভার কমানো ইত্যাদি। ১৮৮৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন শেষ হয়।
তবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সর্বাধিক কৃতিত্ত্ব হলো অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম (A. O. Hume) নামক একজন ইংরেজের। ১৮৮২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ভারতে একজন I.C.S. কর্মকর্তা। ১৮৮২ সালে অবসর গ্রহণের পর তিনি ভারতীয়দের স্বার্থ আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে জড়িত করেন। অবশ্য জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে হিউমের অন্য উদ্দেশ্য কাজ করেছিল। হিউমের জীবনী লেখক স্যার উইলিয়ম ওয়েডারবর্ণ (Sir William Wederburn) লিখেছেন যে, প্রায় ৩০ হাজার গোয়েন্দা রিপোর্ট পড়ে হিউমের মনে এ আশঙ্কার জন্ম নেয় যে, ভারতে খুব শীঘ্রেই একটি ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লব অত্যাসন্ন। এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, ১৮৭০ দশকের সময়টি ছিল ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ও দুঃখ দুর্দশার যুগ। দাক্ষিণাত্যের কৃষক বিদ্রোহ, মাতৃভাষা সংবাদপত্র ও অস্ত্র আইন প্রসূত গণ-বিক্ষোভ ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে এক অস্বস্তিকর ও আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল।
যাহোক, হিউম ভারতীয়দের অসন্তোষ প্রশমিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে তাদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক, মানসিক ও নৈতিক উৎকর্ষ লাভের জন্য একটি স্থায়ী সংস্থা গঠনের উপদেশ দেন। তদানীন্তন ভারতের বড়লাট লর্ড ডাফরিনও এ সময় ভারত সরকারের সমালোচনার জন্য একটি বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১৮৮৪ সালের প্রথম দিকে হিউম ডাফরিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁর পরিকল্পনার কথা জানান। ডাফরিন হিউমের পরিকল্পনা সমর্থন করেন। এভাবে সরকারি আনকুল্য নিয়ে ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়।