Home » বাংলাদেশে মন্ত্রী-সচিব সম্পর্কের প্রকৃতি নিরুপন কর। তাদের লোকপ্রশাসন সম্পর্কের ভারসাম্যের জন্য কিছু ব্যবস্থা সুপারিশ কর।

বাংলাদেশে মন্ত্রী-সচিব সম্পর্কের প্রকৃতি নিরুপন কর। তাদের লোকপ্রশাসন সম্পর্কের ভারসাম্যের জন্য কিছু ব্যবস্থা সুপারিশ কর।

by TRI

মন্ত্রী-সচিব সম্পর্ক

                     মন্ত্রী-সচিব সম্পর্ক বর্ণনা করতে হলে আমাদের প্রথমে মন্ত্রী ও সচিব সম্পর্কে জানা দরকার।
                     মন্ত্রী হচ্ছেন জনগণের প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি প্রজাতন্ত্রের সরকার প্রধান (প্রধানমন্ত্রী) – এর ইচ্ছাক্রমে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ের শীর্ষে থাকেন একজন মন্ত্রী।
                     সচিব শব্দটির ইংরেজী শব্দ Secretary। Secretary শব্দটি ল্যাটিন Secretarious শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ গোপন পত্র বিনিময়কারী। Oxford Dictionary অনুযায়ী Secretary হল এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোন সংস্থা বা কোম্পানির লেখা পত্র সংরক্ষণ, বিভিন্ন ব্যবসায়ীক কার্যাবলী সম্পাদন ইত্যাদির জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হন।

                     বস্তুত, বর্তমান কালের সচিব হচ্ছেন সরকারি কর্মচারী (Public Servant) বা সুশীল সেবাকর্মী। তিনি প্রজাতন্ত্রের বিধি-বিধান অনুসারে মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে কাজ করেন। তার নিয়োগ PSC অথবা MOE (Minister of Establishment) কর্তৃক হয়। তিনি মন্ত্রণালয়ের কার্যনির্বাহীর প্রধান।
                     পূর্বোক্ত আলোচনা বিশ্লেষণ করলে মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে আমরা নিম্নোক্ত পার্থক্য পাই- 

                                       মন্ত্রী
                               সচিব
১. মন্ত্রী রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত। ১. সচিবরা সরকারি আমলা।
২. বিশেষ রাজনৈতিক দল দ্বারা প্রভাবিত। ২. সচিবরা রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ।
৩. কোন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ না হয়েও সে বিষয়ে মন্ত্রী হতে পারে। ৩. সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন।
৪. মন্ত্রীর কাজ নির্দেশনা প্রদান করা। ৪. সচিবের কাজ পরামর্শ করা।
৫. জনচক্ষুর সম্মুখে কাজ করেন। ৫. জনচক্ষুর অন্তরালে কাজ করেন।
৬. মন্ত্রী অস্থায়ী। ৬. সচিব স্থায়ী।
৭. মন্ত্রীরা সংসদ ও জনগণের কাছে জবাবদিহি করেন। ৭. সচিবরা মন্ত্রণালয়ের নিকট দায়ী থাকেন।

আরও পড়তে পারেনমিনোব্রুক সম্মেলন – ১, ২, ৩    

মন্ত্রী-সচিব বিরোধ

                   মন্ত্রী-সচিব সম্পর্ক সহযোগীতামূলক হলেও অনেক সময়ে তাদের মাঝে ঠান্ডা লড়াই পরিলক্ষিত হয়। বিভিন্ন কারণে মন্ত্রী-সচিব সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। যেমন-
১. মন্ত্রীদের প্রশাসনিক অনভিজ্ঞতা ও অদক্ষতার কারণে অনেক সময় সচিবরা তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন। নিজেদেরকে মন্ত্রীর চাইতে যোগ্য মনে করেন।
২. মন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ এবং এলাকভিত্তিক। কিন্তু একজন সচিবের দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে সমগ্র দেশ ভিত্তিক।
৩. মন্ত্রীরা অস্থায়ী কিন্তু সচিবরা স্থায়ী (সরকার পরিবর্তন হলেও তারা কাজে বহাল থাকেন। তাই সচিবরা অনেক সময় মন্ত্রীদের অগ্রাহ্য করে।
৪. পরস্পরের প্রতি সন্দেহ ও অবিশ্বাস।

মন্ত্রী ও সচিবের কাজের মধ্যে মৌলিক ও গুণগত কিছু পার্থক্য বিদ্যমান। দুজনের কাজ সম্পূর্ণ আলাদা হলেও পরস্পরের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। মন্ত্রী-সচিবের সম্পর্কের মধ্যে যে সব বিষয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেগুলো হলো-
ক) প্রশাসনিক নীতি (Administrative Policy)
খ) সাধারণ প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ(General Administration & Control)
গ) সংসদ বিষয়ক(Parliamentary Business)
ঘ) পরিকল্পনা প্রণয়ন(Planning)

ক) প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণ

                প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণে মন্ত্রী ও সচিবের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। নীতি নির্ধারণে সচিবরা দু’ধরণের দায়িত্ব পালন করেন। এগুলো হলো-
               ১. মন্ত্রীদের প্রণতি নীতিকে বাস্তবমুখী করণে সহায়তা, এবং
               ২. প্রণীত নীতিকে বাস্তবায়ন করা।
তাই নীতি নির্ধারণের সময় সচিবগণ তাদের মন্ত্রীদের সামনে বিশেষ কোন সমস্যা থাকলে তুলে ধরেন এবং মন্ত্রীকে পরামর্শদানের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহেণে ভূমিকা রাখেন।

খ) সাধারণ প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ

             সচিবরা মন্ত্রণালয়ের কর্মসূচী প্রণয়নের ব্যাপারে সকল প্রকার উপাত্ত, তথ্য, সংবাদ প্রমাণাদি, বিষয়সমূহ সংরক্ষণ, মুল্যায়ন ও সমন্বয় সাধনের মত গুরু দায়িত্ব পালন করে প্রশাসন পরিচালনা ও নিয়্ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মন্ত্রীদের সহায়তা করেন।

গ) সংসদ বিষয়ক

               সচিবরা মন্ত্রীদেরকে সংসদ বিষয়ক যে সব ব্যাপারে সহায়তা করে থাকেন সেগুলো হলো-
               ১. আইন প্রণয়ন
               ২. অর্থ সংক্রান্ত
               ৩. সংসদীয় প্রশ্নমালা

১. আইন প্রণয়ন

                আইন সভায় বিভিন্ন কারণে যে আইন প্রণয়ন করা হয় তাতে সচিবগণ মন্ত্রীদের পরামর্শ দান করেন। আইন প্রণয়নে দুটি পর্যায় আছে। যেমন-

খসড়া প্রণয়ন সংক্রান্ত

                 সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিল প্রস্তুত করা থেকে শুরু করে কেবিনেটের অনুমোদন নেয়া পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম সম্পাদন করে আইন মন্ত্রণালয়ে পেশ করেন সচিব। একাজ অত্যন্ত জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। মন্ত্রী তা সংসদে উপস্থাপন করে মাত্র।

সংসদীয় পর্যায়

                সংসদে বিল উপস্থাপনের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর। এখানে সচিবের সরাসরি ভূমিকা না থাকলেও সংসদ অধিবেশন চলাকালে সচিব মন্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি সরবরাহ করেন। এবং মন্ত্রীকে সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি বুঝিয়ে দেন।

২. অর্থ ও বাজেট সংক্রান্ত

                 অর্থ ও বাজেট সংক্রান্ত কাজগুলো মন্ত্রীরা সচিবের মাধ্যমে করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ার দুটো স্তর রয়েছে।

প্রস্তুতিমূলক স্তর

                এ স্তরে মন্ত্রীগণ স্ব-স্ব সচিবের সাথে পরামর্শ করে প্রস্তাবিত বাজেট বরাদ্দ, নিরীক্ষা কাজ পরিচালনা করেন এবং তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পেশ করেন।

সংসদীয় স্তর

                সংসদে বাজেট অধিবেশন চলাকালে সদস্যরা বিভিন্ন ধরণের হিসাব-নিকাশ এবং অতীত ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। মন্ত্রীকে এ সংক্রান্ত তথ্যাদি সরবরাহ করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবগণ। সচিব তার মন্ত্রণালয়ের হিসাব পরীক্ষক।

৩. সংসদীয় প্রশ্নমালা

                সংসদে অনেক বিষয়ে মন্ত্রীদেরকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সচিবদের সাহায্য ছাড়া মন্ত্রীগণ সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না। প্রশ্নের উত্তর তৈরীর ব্যাপারে মন্ত্রীগণ সচিবদের উপর অনেকটা নির্ভরশীল।

ঘ) পরিকল্পনা প্রণয়ন

                জনগণের কল্যাণ সাধনে বিভিন্ন বিষয়ে কি  কি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত সে ব্যাপারে সচিবরা মন্ত্রীদেরকে পরামর্শ প্রদান করেন।

মন্ত্রী-সচিব সম্পর্ক উন্নয়নে সুপারিশ

                 মন্ত্রী-সচিব সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো করা যায়-
১. উভয় পক্ষকে আন্তরিক হতে হবে। নিজেদের মধ্যে রেষারেষি বাদ দিয়ে দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে।
২. মন্ত্রীদের প্রতি সচিবদের শ্রদ্ধা ও বিশ্বস্ততা আর সচিবদের প্রতি মন্ত্রীদের আস্থা রাখতে হবে।
৩. মন্ত্রীদের হতে হবে ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা আর প্রশাসনিক দক্ষতার অধিকারী।
৪. উভয়কে তাদের দায়িত্বের গন্ডী সম্পর্কে সচেতন হতে হবে।
৫. আমলাতন্ত্রকে রাজনীতির নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
৬. উভয়ের কাজের মধ্যে সুষ্ঠু সমন্বয় থাকতে হবে।
৭. রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে গণতন্ত্রের মূল ভিত্তির উপর দাঁড় করতে হবে।                 
মন্ত্রী-সচিবের সম্পর্কের প্রকৃতি সম্পর্কিত আলোচনায় এ কথা বলা যায় যে, মন্ত্রী ও সচিবের মধ্যে যে সম্পর্ক তা পারস্পরিক সহযোগীতামূলক হতে হবে। উভয়ের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামোর জন্য অপরিহার্য।

Related Posts