ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অতি গুরুত্বপূর্ণ। অপরদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অধিকতর শক্তিশালী। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী এই দুই দেশে মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকলেও বাংলাদেশ একটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্র। অন্যদিকে ভারত বিভিন্ন জাতির সমষ্টিগত একটি দেশ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎস
ভারতের প্রধানমন্ত্রী অনেক ক্ষমতার অধিকারী। কেননা তিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে জনগণের রায়ে নির্বাচিত হন। নিম্নে তাঁর ক্ষমতার উৎসসমূহ আলোচনা করা হলো-
১) জনমত: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অন্যতম উৎস হলো জনমত। কেননা, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জনগণের রায়ে নির্বাচিত হন। জনগণ যে দলে বেশি রায় দেয় সে দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে এবং সে দল থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়। সুতরাং একথা বলা যায় যে, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার প্রধান উৎস হলো জনগণের মতামত বা রায়।
২) সংবিধান: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক ভাবে নির্বাচিত হন বিধায় তাঁর ক্ষমতার উৎস হলো সংবিধান। ভারতীয় সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা ও কার্যাবলি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ক্ষমতাবলে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এ কারণে তাঁর সিদ্ধান্ত সহসাই পরিবর্তন করা সম্ভব হয় না।
৩) দলীয় ক্ষমতা: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন দলীয়ভাবে। সংসদে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, সে দল থেকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এজন্য দলের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। দলের কর্মীদের পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী অনেক কার্যক্রম সম্পাদন করেন। সুতরাং দলীয় ক্ষমতা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার একটি অন্যতম উৎস।
৪) মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবর্গ থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতা: প্রধানমন্ত্রী যেহেতু একা সকল কাজ সম্পাদন করতে পারেন না সেহেতু তিনি মন্ত্রীপরিষদের সদস্যদের সহযোগিতা ও পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি মন্ত্রীপরিষদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরণের সাহায্য-সহযোগিতা লাভ করেন বিধায় যে কোন ধরণের সিদ্ধান্ত নিতে পিছপা হন না। সুতরাং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার একটি অন্যতম উৎস হলো মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবর্গ থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতা।
৫) প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা ও ব্যক্তিত্ব: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাবান ব্যক্তিদের মধ্যে একজন। তিনি মহান ও বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন। এজন্য তিনি যেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার মত থাকে না। সুতরাং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অন্যতম উৎস হলো তাঁর পদমর্যাদা, ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতা।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনীতির সামরিকীকরণ প্রক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎস
বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা বিদ্যমান। জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হলেন নামমাত্র শাসক প্রধান। প্রকৃত শাসন ন্যস্ত থাকে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। অর্থাৎ তিনিই শাসন ব্যবস্থার মধ্যমণি এবং সরকার প্রধান। নিম্নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎসসমূহ আলোচনা করা হলো।
১) জনগণ: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার অন্যতম উৎস হলো জনগণ। কেননা, তিনি জনগণের দ্বারাই নির্বাচিত হন। জনগণ যে দলে বেশি ভোট দিবেন সে দল থেকেই সরকার প্রধান নির্বাচিত হবেন। সুতরাং, বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার উৎস হলো জনগণ।
২) সংবিধান: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত হন। সংবিধান অনুযায়ী তিনি তাঁর ক্ষমতা প্রয়োগ করেন এবং তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি সমূহ সম্পাদন করেন। তাই বলা যায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এর ক্ষমতার উৎস সংবিধান।
৩) মন্ত্রীসভা থেকে প্রাপ্ত ক্ষমতা: প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করেই মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ও পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ সংবিধানের ৫৫(১) অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে, “প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রীসভা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী সময়ে সময়ে যেরূপ নিয়ম বা আইন স্থির করবেন, সেইরূপ অনুযায়ী তিনি অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ে এই মন্ত্রীসভা গঠিত হবে।” প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার মন্ত্রীবর্গের সাথে পরামর্শ করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং এক্ষেত্রে মন্ত্রীবর্গও প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্য সহযোগিতা করেন। সুতরাং বলা যায়, প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভা থেকে সংবিধান অনুযায়ী ক্ষমতা লাভ করেন।
৪) দলীয় ক্ষমতা: প্রধানমন্ত্রী হলেন তাঁর নিজ দলের নেতা। এজন্য তিনি দলীয় স্বার্থরক্ষা, ঐক্য রক্ষা, দলের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সচেষ্ট হন। তিনি দলের সদস্যদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী যেকোন একটি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে নির্বাচিত হন, সেহেতু তিনি এ দল থেকে দলীয় ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন। তাই বলা যায়, দলীয় ক্ষমতা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার উৎস।
৫) প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদা: সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শুধু সমপর্যায়ভূক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অগ্রগণ্যই নয়, তিনি হলেন সংসদের নেতা, মন্ত্রীসভার মধ্যমণি, দলের নেতা এবং জাতির নেতা। সে হিসেবে তিনি আলাদা ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাই তিনি যে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন সেই সিদ্ধান্তটি গৃহীত হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎসের মিল ও অমিল
মিলসমূহ
১) ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার উৎসের মিল খুঁজে পাওয়া যায় জনমতের ক্ষেত্রে। কেননা, উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন।
২) উভয় দেশেই প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রীসভার সদস্যগণ ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে তাদের কাজের জন্য আইনসভার নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন।
৩) দুই দেশেই প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন মন্ত্রীসভার নেতা, আইনসভার নেতা, নিজ দলের সংসদীয় নেতা এবং জাতীয় নেতা।
৪) দুই দেশেই প্রধানমন্ত্রীকে কেন্দ্র করে কেবিনেট কার্য পরিচালনা করে এবং তাঁর পতন ঘটলে তাঁকে কেন্দ্র করেই ঘটে।
অমিলসমূহ
১) ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাবান হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
২) বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশ সংবিধান যতটুকু ক্ষমতা প্রদান করেছে, ভারতীয় সংবিধান ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ততটুকু ক্ষমতা প্রদান করে নি। অর্থাৎ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এর তুলনায় কম শক্তিশালী। এজন্য ভারতের সরকার ব্যবস্থাকে বাংলাদেশের তুলনায় Less Prime-Ministerial বলা হয়।