ভারতের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ
দক্ষিণ এশিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ এর দীর্ঘ ইতিহাস থাকলেও ভারতে তার কোনো নজির নেই। এজন্য ভারতকে এখনো দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ বলা হয়।
ভারতের প্রথম দিকের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জনগণ এবং সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কর্তৃক সম্মানিত ছিলেন। যার দরুণ বেসামরিক প্রশাসনের উপর সামরিক বাহিনীর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ ঘটেনি। এমনকি সামরিক প্রশাসনের যাবতীয় কার্যাবলি চালিত হত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে যার অধিকাংশ কর্মকর্তা বেসামরিক।
ভারতের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ না হওয়ার আরও কিছু কারণ নিম্নে আলোচনা করা হল-
পারস্পরিক শ্রদ্ধা
প্রথম প্রজন্মে ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাধারণ জনগণের পাশাপাশি সামরিক বাহিনীরও সম্মান অর্জন করত। তখন সামরিক প্রশাসন বেসামরিক প্রশাসনের উপর কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করত না। এমনকি বেসামরিক প্রশাসনকে কোন প্রকার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীনও হতে হয় নি।
সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া
ভারতে পারমাণবিক ও রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যাপারে সামরিক বাহিনী কোন প্রকার সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে কোন প্রকার দ্বন্ধ দেখা দিলে তা দ্রুত নিরসনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
পারস্পরিক সুসম্পর্ক
ভারতে সকল সময়ে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সামরিক অফিসারদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিরাজ করে। যেমন- জেনারেল Thimayya যখন তার পদত্যাগপত্র পেশ করেন তখন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তার পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করে নিতে অনুরোধ করেন এবং তিনি তা মান্য করেন। পারস্পরিক এ সুসম্পর্ক ভারত এবং পাকিস্তানে বিরল।
আরও পড়ুন: রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণ কি? রাজনীতিকরণ ও দলীয়করণের মধ্যে পার্থক্য
পৃথক অবস্থান
অন্যান্য বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের ন্যায় ভারতের সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর সরকার হতে পৃথক। সেখানে সামরিক বাহিনী civil government এর আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন প্রকার বিদ্রোহ দমন, ত্রাণ পূনর্বাসন কার্যক্রম এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময় সামরিক বাহিনীকে তৎপর দেখা যায়।
সুষ্ঠু নিয়োগ এবং প্রশিক্ষণ
জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল স্তর থেকে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ দান করা হয়, ফলে অসন্তোষের সম্ভাবনা থাকে না। আর সামরিক বাহিনীর সদস্যদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় যাতে তারা রাজনীতি বিমুখ হয় এবং জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ থাকে।
জরুরি অবস্থা
ভারতে সামরিক এবং বেসামরিক প্রশাসন সবচাইতে কঠিন সময় পার করে জরুরি অবস্থা চলাকালীন সময়ে (২৫ জুন ১৯৭৫ -২৩ মার্চ ১৯৭৭)। এ সময় পুলিশ বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসন জরুরি অবস্থা কার্যকরী করার কাজে নিয়োজিত থাকলেও সামরিক বাহিনী এর থেকে বিরত থাকে।
রাজনৈতিক সংলাপ
ভারতের সেনাবাহিনী কখনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা রাজনৈতিক সংলাপে হস্তক্ষেপ করেনি। তারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের আজ্ঞাবহ থেকে তাদের আদেশ মান্য করে।
ভারতের রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ না হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ ভারতীয় জনগণ এবং বেসামরিক প্রশাসনের সামরিক শাসন বিমুখতা। এ কারণে ভারতে সামরিক অভ্যুত্থান দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলসমূহ সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিকায়িত করার চেষ্টা করলেও তারা সফল হয়নি। বেসামরিক প্রশাসনের কোন সিদ্ধান্তের প্রতি চ্যালেঞ্জ করার মানসিকতা ভারতের সামরিক প্রশাসনের নেই। সর্বোপরি, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, সুশৃঙ্খল অবস্থা ইত্যাদির কারণে তারা রাজনীতির পরিধির বাইরে থেকে দেশের সেবায় নিজেদের আত্মনিয়োগ করে।
একটি ঘটনা
৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৮ সালে নেভি প্রধান Admiral Vishnu Bhagwat কে অপসারণ করা হয়, কারণ তিনি বেসামরিক প্রশাসনের প্রাধান্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তার এই অপসারণকে কেন্দ্র করে সরকার এবং সামরিক প্রশাসনের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। যার দরুণ একটি রাজনৈতিক দল (AIADMK) সরকার হতে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে সরকার আস্থাভোট অর্জনে ব্যর্থ হয় এবং পুনরায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে এমন উদাহরণের কথা কল্পনারও করা যায় না।