চাহিদা সোপান তত্ত্ব কি?
চাহিদা সোপান তত্ত্বের জনক হল আব্রাহাম মাসলো। তিনি সার্বজনীনভাবে ব্যাক্তির আচরণে প্রেষণা তৈরিতে কতিপয় প্রণোদনা চিহ্নিত করেছেন এবং সেগুলো সন্তুষ্টি বিধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বানুসারে পদসোপানিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। মাজলো মনে করেন মানুষের আচরণ উদ্দীপ্ত কারণের যে চাহিদাগুলো রয়েছে, সেগুলি পর্যায়ক্রমিকভাবে মানুষের মাঝে উদগত হয় এবং একবার কোন পর্যায়ের একটি চাহিদা মিটে গেলে সেটি আর আচরণকে প্রেষিত করতে পারেনা। পদসোপানের ঠিক পরবর্তী পর্যায়ের চাহিদাটি তখন সক্রিয় হয় এবং ব্যক্তি সেটি অর্জনে প্রেষিত হয়।
মাসলো চাহিদা সোপান তত্ত্বে পাঁচ ধরণের চাহিদা বা অভাব চিহ্নিত করেছেন:
১) জৈবিক চাহিদা (Physiological Need)
আব্রাহাম মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বে সোপানের সর্বাপেক্ষা মৌলিক এবং প্রাথমিক পর্যায়ের চাহিদা হলো জৈব চাহিদা। এই চাহিদাগুলি হলো ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ঘুম, নিরাপত্তা, সেক্স ইত্যাদি। এই তত্ত্বানুসারে একবার এই মৌলিক চাহিদাগুলো অর্জিত হয়ে গেলে, পরবর্তীতে এগুলি পেতে ব্যক্তি আর প্রেষিত হয় না, তাৎক্ষণিকভাবে ব্যক্তি পরবর্তী পর্যায়ে চাহিদা অর্জনে ব্রতী হয়। উদাহরণস্বরুপ একজন ক্ষুধার্ত ব্যক্তি ক্ষুধা নিবারণের জন্য তার নাগালের মধ্যে যদি একটি ‘শসা’ থাকে সেটি অর্জনের মাধ্যমে ক্ষুধা নিবারণ হয়ে গেলে সে ব্যক্তিটি আরো শসা পেতে আর আগ্রহী হবে না, বরং চাহিদা সোপানের পরবর্তী উচ্চ পর্যায়ের প্রয়োজন পূরণে আগ্রহী হবে।
২) নিরাপত্তার চাহিদা (Safety Need)
দ্বিতীয় পর্যায়ের চাহিদা মূলত ব্যক্তির জৈবিক ও মনস্তাত্ত্বিক নিরাপত্তার সাথে সম্পৃক্ত। মাসলো নিরাপত্তা বলতে ব্যক্তির আবেগ প্রসূত আচরণের এবং শরীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডের নিরাপত্তার কথা বলেছেন। তিনি মানবসত্ত্বাকে নিরাপত্তা প্রার্থী সত্ত্বা বলেছেন। জৈবিক চাহিদার মতই নিরাপত্তার চাহিদা পূরণ হয়ে গেলে ব্যক্তি আর তার জন্য প্রেষিত হয় না।
৩) সামাজিক চাহিদা (Social Need)
মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বের তৃতীয় এবং মধ্যবর্তী পর্যায়ের চাহিদা হলো ব্যক্তির স্নেহ-মমতা, ভালোবাসা পাবার চাহিদা। পারস্পরিক স্নেহ-ভালোবাসা প্রাপ্তির প্রত্যাশা ব্যক্তি অনুভব করে এবং এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক বিষয়। গোষ্ঠীগত ইতিবাচক সম্পর্কের চাহিদাই মাজলোর তৃতীয় পর্যায়ের সামাজিক চাহিদার অন্তর্ভূক্ত।
৪) আত্ম সম্মান বোধের চাহিদা (Esteem Need)
আত্মসম্মান বোধের চাহিদা মাসলোর চাহিদা সোপান তত্ত্বের উচ্চ পর্যায়ের একটি চাহিদা। ক্ষমতা, কৃতিত্বার্জন এবং পদমর্যাদার চাহিদা এই পর্যায়ের চাহিদা। মাসলো আত্মসম্মান বোধের চাহিদাকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। একটি স্ব-সম্মানবোধ এবং আরেকটি অন্যের নিকট থেকে সম্মানবোধ।
আরও পড়ুন: পদসোপান নীতি কি? পদসোপান নীতির সুবিধা-অসুবিধা কি কি?
৫) আত্ম প্রতিষ্ঠার চাহিদা (Self Actualization)
মাসলোর তত্ত্বের উচ্চ পর্যায়ের এই চাহিদাটি নিম্ন, মধ্যবর্তী এবং উচ্চ পর্যায়ের সকল চাহিদা পূরণ ও প্রাপ্তির চূড়ান্ত পর্যায়ের প্রতিনিধিত্ব করছে। সর্বোচ্চ স্তরের এই চাহিদা অর্থাৎ আত্ম প্রতিষ্ঠার চাহিদা প্রাপ্তির মাধ্যমে ব্যক্তি তার মাঝে বিদ্যমান সুপ্ত প্রতিভা অনুধাবনে সক্ষম হয় ও তার পূর্ণ বিকাশে সক্ষম হয়। কার্যত: এই স্তরের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে ব্যক্তি তার প্রতিভা, প্রজ্ঞা, দক্ষতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় এবং তা কার্যে পরিণত করতে প্রত্যয়ী হয়।
চাহিদার পদক্রমিক তত্ত্বটি প্রকৃতপক্ষে মানুষকে লক্ষ্য অর্জনে প্রেষিত করার একটি সার্বজনীন তত্ত্ব। মাসলো সুনির্দিষ্টভাবে কর্মপ্রেষণার ক্ষেত্রে তত্ত্বটিকে সরাসরি প্রয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন না। তবে পরবর্তীতে তাত্ত্বিকগণ মাজলোর তত্ত্বকে ভিত্তি করে কর্মপ্রেষণার বিভিন্ন এপ্রোচের বিকাশ ঘটিয়েছেন। এদিক থেকে প্রেষণার আধুনিক ব্যবস্থাপনা তত্ত্বের বিকাশে মাসলোর তত্ত্বের প্রভূত প্রভাব রয়েছে।