প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর কার্যকারিতা
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো সর্বভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন। এ লক্ষ্যে ১৯১৯ সালে প্রবর্তিত প্রদেশের দ্বৈতশাসনকে বাতিল করা হয়। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনকে কার্যকর করার জন্য প্রাদেশিক মন্ত্রিসভাকে আইনসভার নিকট দায়ী করা হয়। তত্ত্বগতভাবে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও বাস্তবে এ ব্যবস্থা কতটুকু কার্যকরী ছিল তা নিচের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
১. প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠান
প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা কার্যকর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রাদেশিক আইন পরিষদ গঠনের জন্য ১৯৩৭ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। নির্বাচনে সর্ব- ভারতীয় দুটি রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। নির্বাচনে উভয় দলই প্রায় অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে তুমুল প্রচারাভিযানে অবতীর্ণ হয়।
মর্লে মিন্টো সংস্কার আইন ১৯০৯ ব্যাখ্যা কর |
২. কংগ্রেসের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন
১৯৩৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস হিন্দু প্রধান পাঁচটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। প্রদেশগুলো হলো মাদ্রাজ, মধ্য প্রদেশ, যুক্ত প্রদেশ, উড়িষ্যা ও বিহার। পক্ষান্তরে, বাংলা, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে কংগ্রেস পরাজিত হয়।
৩. মন্ত্রিসভা গঠন
কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঁচটি প্রদেশ এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে মন্ত্রিসভা গঠন করে। তাছাড়া ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস আসামে কোয়ালিশন (Coalition) মন্ত্রিসভা গঠন করে।
অন্যদিকে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু ও আসামে মুসলিম লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কয়েকটি প্রদেশে কোয়ালিশনে মন্ত্রিসভা গঠিত হলেও কংগ্রেস বাংলা ও সিন্ধু প্রদেশের কোয়ালিশনে যোগ দেয়নি।
৪. কংগ্রেস মুসলিম লীগ সংহতি সমস্যা
১৯৩৫ সালের আইনে উল্লেখ করা হয় যে, প্রাদেশিক মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে; কিন্তু মন্ত্রিসভা গঠনের সময় কংগ্রেস তা উপেক্ষা করে। কংগ্রেস মুসলিম লীগকে একটি স্বতন্ত্র দল হিসেবে প্রতিপন্ন না করে বরং কংগ্রেস একতরফাভাবে মন্ত্রিসভা গঠন করে।
৫. কংগ্রেসের ভূমিকা
কংগ্রেস একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আধিপত্য বিস্তারের যে মনোভাব পালন করছিল, মুসলিম লীগের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। মূলত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নে কংগ্রেস স্বল্প সময়ই জড়িত ছিল। কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভারতীয়দের সম্মতি ছাড়া যুদ্ধ ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৩৯ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে কংগ্রেস আটটি প্রদেশের মন্ত্রিসভা থেকে একযোগে পদত্যাগ করে।
৬. ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি ও কংগ্রেসের সহযোগিতা
কংগ্রেস ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানায় যে, গভর্নর মন্ত্রিসভার কাজে কোনোরূপ হস্তক্ষেপ করবে না। ব্রিটিশ সরকার এতে সম্মত হয়। কংগ্রেসীয় মন্ত্রিসভা প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন বাস্তবায়নে ব্রিটিশ সরকারকে সহযোগিতা করেছিল। কারণ মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাথে গভর্নরদের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। তবে বিহার ও যুক্ত প্রদেশে রাজবন্দীদের মুক্তি নিয়ে গভর্নরদের সাথে মতানৈক্যের ফলে কংগ্রেসীয় মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে। যদিও পরে এ সমস্যার সমাধান হয়।
ভারতীয় কাউন্সিল আইন ১৮৬১ ব্যাখ্যা কর |
৭. মুসলিম লীগের ভূমিকা
কংগ্রেস দলীয় সদস্যগণ যখন একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মুসলিম লীগ সদস্যদের দলে ফেরানোর অপপ্রচেষ্টা শুরু করে তখন মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিভিন্ন প্রচারাভিযানে বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সাথে কোনো সমঝোতা সম্ভব নয়। ভারতবর্ষে মুসলিম লীগ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। পরবর্তীকালে প্রাদেশিক পরিষদের মুসলমান সদস্যদের মুসলিম লীগে যোগদানের আহ্বান জানিয়ে জাতীয় আন্দোলনের ডাক দেন। ফলশ্রুতিতে বাংলা, পাঞ্জাব ও আসামের প্রধানমন্ত্রীগণ তাদের সহযোগী ও সমর্থকসহ মুসলিম লাগে যোগ দেন।
৮. উপনির্বাচনে মুসলিম লীগের বিজয়
পরবর্তীকালে কয়েকটি উপনির্বাচনে মুসলিম লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। ১৯৩৭-৪২ সাল পর্যন্ত মুসলিম আসনে মোট ৬১টি উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তন্মধ্যে ৪৭টি মুসলিম লীগ, ১০টি স্বতন্ত্র এবং ৪টি আসনে কংগ্রেস দলীয় প্রার্থী জয়ী হয়।
সুতরাং ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রবর্তিত প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থা ছিল অর্থহীন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের ঐকান্তিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও গভর্নর জেনারেল, গভর্নর এবং ভারত সচিবের অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন এর কার্যকারিতা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।