ই গভর্নেন্স কি বা কাকে বলে?
ই-গভর্নেন্স হলো ইলেকট্রনিক গভর্নেন্স (Electronic Governance) কথাটির সংক্ষিপ্ত রূপ। ই-গভর্নেন্স বলতে বোঝায় প্রযুক্তিনির্ভর শাসন।
সহজভাবে বলা যায়, যে পদ্ধতিতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (ICT) মাধ্যমে জনগণ খুব সহজে সরকারের বিভিন্ন সেবা পেয়ে থাকে তাই ই-গভর্নেন্স।
ফরিদ ও শরিফ দুই ভাই। ফরিদ ২০১১ সালে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছিল। সে পাসপোর্ট হাতে পায় অনেক ভোগান্তির পরে। ফরিদ প্রথমে পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণ করে খুব ভোরে গিয়ে পাসপোর্ট অফিসে লাইনে ‘ দাঁড়ায়। সেদিন লোকের এত ভিড় ছিল যে, সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা শুধু তার কাগজপত্রগুলো যাচাই করে ছবি তোলার জন্যে পরদিন আসতে বলেন। পরের দিনও ফরিদ খুব ভোরে পাসপোর্ট অফিসে যায়। ছবি তোলার সিরিয়াল পেতে পেতে তার প্রায় সারাদিন চলে যায়। পরে আরেকদিন তাকে পাসপোর্ট গ্রহণ করার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হয়।
ফরিদের ভাই শরীফ পাসপোর্টের জন্য আবেদন করে এর দুই বছর পর, ২০১৩ সালে। তখন শরিফ ঘরে বসেই ইন্টারনেটের সাহায্যে পাসপোর্টের আবেদন ফরম পূরণ করে প্রিন্ট নেয়। সে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে ফরমটির প্রিন্ট কপি জমা দেওয়ার পর আঙুলের ছাপ দেয়। এর পর আবেদনে উল্লেখকৃত নির্দিষ্ট দিনে পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে পাসপোর্টটি নিয়ে আসে।
সহোদর ভাই ফরিদ ও শরিফের পাসপোর্টের আবেদন ও প্রাপ্তির ধরনের ক্ষেত্রে মূল পার্থক্য হলো ই-গভর্নেন্স। ফরিদ দুই বছর আগে ই-গভর্নেন্সের সেবা পায়নি। অপরদিকে শরিফ ঐ আধুনিক সেবা পেয়েছে। ই-গভর্নেন্স হচ্ছে মূলত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (ICT)-i সাহায্যে সরকারি সেবাদান। এর মধ্যে আরও যেসব বিষয় যুক্ত সেগুলো হচ্ছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও সরকার, সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যবস্থা।
আরও দেখুন: গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের গুরুত্ব বর্ণনা
টমাস এফ গর্ডন (Thomas F. Gordon) ই-গভর্নেন্সের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘ইন্টারনেটের মতো তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি কৌশল ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় সেবা উন্নয়নের পদ্ধতি হলো ই- গভর্নেন্স।’ (E-Governance is simply the use of information and communication technology, such as the internet to improve the process of government.)
ই-গভর্নেন্সের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি বিজ্ঞানী এ. পি. জে আব্দুল কালাম বলেছেন, একটি স্বচ্ছ ও চৌকশ ই গভর্নেন্স ব্যবস্থায় অবাধ, নিরাপদ ও নির্ভুল তথ্য প্রবাহের মাধ্যমে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে দূরত্ব ঘুচিয়ে নাগরিকদের স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ সেবা দেওয়া যায়। (A transparent, smart e-governance with seamless access, secure and authentic flow of information crossing the interdepartmental barrier and providing a fair and unbiased service to the citizen.)
২০০৬ সালে জাতিসংঘ প্রদত্ত এক সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘সরকারি তথ্য ও সেবা ইন্টারনেট এবং ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌছানোর ব্যবস্থাই হলো ই-গভর্নেন্স।’ (E-Governance is defined as the employment of the internet and the world wide web for delivering government information and service to the citizens.)
জাতিসংঘের সংস্থা UNESCO-র সংজ্ঞানুযায়ী, ‘ই-গভর্নেন্স হলো ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সরকারি এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডকে কার্যকর, দ্রুততর ও স্বচ্ছতর করার একটি প্রক্রিয়া।’
বিশ্বব্যাংক (World Bank)-এর মতে, ‘ই-গভর্নেন্স বলতে সরকারি তথ্যপ্রযুক্তি (নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার প্রভৃতি) ব্যবহারের মাধ্যমে জনগণ, ব্যবসায়িক পক্ষ এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগের মধ্যে যোগাযোগের সক্ষমতাকে বোঝায়।’ (E-Governance refers to the use by government agencies of information technologies (such as networking, Internet, Mobile, Computer etc.) that have the ability to transform relations with citizens, businesses and other arms of government.)
ভারতের তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হিসেবে সুপরিচিত রাজ্য অস্ত্র প্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডু ই- গভর্নেন্সকে ‘SMART Government’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি SMART শব্দের পূর্ণরূপ ব্যাখ্যা করেন এভাবে- S=Simple, M = Moral, A = Accountable, R = Responsive, T = Transparent অর্থাৎ নাইডুর ই-গভর্নেন্সের ধারণার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে সহজতা, নৈতিকতা, জবাবদিহিতা, দ্রুত সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা ও স্বচ্ছতা।
ই-গভর্নেন্স এর ধারণাটিকে নিচের ছকের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায়-
বিভিন্ন লেখক ই-গভর্নেন্সের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কথা বলেছেন। আমেরিকান রাষ্ট্রবিজ্ঞানী (Health Hicks) হিকস ই- গভর্নেন্সর প্রধান তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন। যথা- ই-প্রশাসন (E-Administration), ই-সেবা (E-Services) এবং ই-সমাজ (E-Society)। অন্যদিকে, Universiry of Albany, USA এর লোক প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ডয়েস (Sharon Dawes) এর মতে-ই গভর্নেন্সের চারটি মৌলিক ক্ষেত্র রয়েছে। এগুলো হলো- ই সেবা (E-Service), ই- গণতন্ত্র (E-Democracy), ই-বাণিজ্য (E-Comerce) এবং ই-ব্যবস্থাপনা (E-Managment)।
নিচে ই-গভর্নেন্সের বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হলো-
ক. ই-প্রশাসন (E-Administration): ই-প্রশাসন বলতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনাকে বোঝায়।
খ. ই-নাগরিক (E-Citizen): প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন নাগরিককে ই-নাগরিক বলে। এ সকল নাগরিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন সরকারি তথ্য ও সেবা গ্রহণে সক্ষম।
গ. ই-সেবা (E-Services): ই-সেবা বলতে সরকার প্রদত্ত নাগরিক সেবাকে বোঝায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- অনলাইনে বিভিন্ন সরকারি দলিলপত্র পাওয়ার জন্য নাগরিকের আবেদন এবং পরিসেবার বিল পরিশোধ করা।
ঘ. ই-গণতন্ত্র (E-Democracy): ই-গণতন্ত্র বলতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৃহৎ পরিসরে নাগরিকের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকে বোঝায়।
ঙ. ই-ব্যবস্থাপনা: (E-Managment): ই-ব্যবস্থাপনা বলতে সরকারি নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারকে বোঝায়, যা ই-গভর্নেন্সের বিভিন্ন কার্যক্রম ও সেবার কাজকে ত্বরান্বিত করে।
চ. ই-ব্যবসায় (E-Business): ই-ব্যবসায় বলতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিশেষ করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইনে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, সেবা ও বিতরণ ইত্যাদি ব্যবসায় সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনাকে বোঝায়।