পৌরনীতি কি বা কাকে বলে?
পৌরনীতির ইংরেজি প্রতিশব্দ ‘Civics’। ‘Civics’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে দুটি ল্যাটিন শব্দ- ‘Civis’ ও ‘Civitas’ থেকে। Civis অর্থ ‘নাগরিক’, আর Civitas অর্থ ‘নগররাষ্ট্র’। সুতরাং শাব্দিক অর্থে ‘Civics’ বা পৌরনীতি হলো নগররাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিকদের আচরণ ও কার্যাবলি সংক্রান্ত বিজ্ঞান। উৎপত্তিগত অর্থে নগর ও নগরবাসী সম্পর্কিত রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠান নিয়ে জ্ঞানের যে শাখা গড়ে উঠেছে তাই পৌরনীতি। সংস্কৃত ভাষায় নগরকে ‘পুর’ বা ‘পুরী’ এবং নগরের অধিবাসীদের ‘পুরবাসী’ বলা হতো। এ জন্যই বাংলায় নাগরিক জীবনের অপর নাম ‘পৌর জীবন’ এবং নাগরিক জীবন সম্পর্কিত বিদ্যার নাম ‘পৌরনীতি’।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্র ও সমাজের মধ্যে পার্থক্য কি কি? – আলোচনা কর
প্রাচীন গ্রিসের এথেন্স, স্পার্টা, রোডস প্রভৃতি ছিল এক একটি নগররাষ্ট্র। অপরদিকে, বৈদিক যুগে ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে প্রাচীন ভারতে একাধিক ছোট রাষ্ট্র ও নগররাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। এগুলো গঙ্গা ও যমুনা তীরের উর্বর সমতলভূমি এবং হিমালয়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছিল। নগররাষ্ট্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বৈশালী, বৃজ্জি, মল্ল, শূরসেন, কোশল, কাশী, মগধ, চেদী, অবন্তী, গান্ধার, কম্বোজ ইত্যাদি। বৈদিক এবং আদি বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে এ নগররাষ্ট্রগুলোর উল্লেখ পাওয়া যায়। নগররাষ্ট্রের বাসিন্দাদের মধ্যে যারা রজিনৈতিক অধিকার ভোগ করত অর্থাৎ রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ করত শুধু তাদেরকেই ‘নাগরিক’ বলা হতো। পুরুষরা রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণ করত বলে তাদের নাগরিক বলা হতো। দাস, নারী ও বিদেশিদের রাষ্ট্রীয় কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল না। কালের প্রবাহে আধুনিক যুগে নাগরিকতা ও রাষ্ট্রের ধারণায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। ক্ষুদ্র নগররাষ্ট্রের স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বৃহৎ আকারের জাতীয় রাষ্ট্র।
‘পৌরনীতি’ কথাটি দুটি অর্থে ব্যবহার করা যায়।
১. সংকীর্ণ অর্থে পৌরনীতি অধিকার ও কর্তব্য সংক্রান্ত বিজ্ঞান। নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করাই এর মূল লক্ষ্য।
২. ব্যাপক অর্থে পৌরনীতিকে ‘নাগরিকতার বিজ্ঞান’ (Science of Citizenship) বলে অভিহিত করা হয়। কেননা, পৌরনীতি নাগরিকতার সঙ্গে জড়িত সব বিষয়ই পর্যালোচনা করে।
শিকাগো ইউনিভার্সিটির সাবেক প্রেসিডেন্ট ও উপাচার্য আমেরিকান শিক্ষা দার্শনিক রবার্ট হাচিনস (Robert Maynard Hutchins) পৌরনীতিকে ‘Education for Citizenship’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
বিশ্বের বর্তমান রাষ্ট্রগুলো প্রাচীন গ্রিসের ‘নগররাষ্ট্রের’ (City-State) মতো নয়। এখনকার রাষ্ট্রগুলো ‘জাতি রাষ্ট্র’ (Nation- State) হিসেবে পরিচিত। প্রাচীনকালের নগররাষ্ট্রের তুলনায় আধুনিক জাতি রাষ্ট্রগুলো সাধারণত আয়তনে বিশাল এবং এগুলোর জনসংখ্যাও অনেক বেশি। এজন্য আজকের রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবন ও কার্যকলাপ জটিল এবং বহুমুখী হয়ে থাকে। আধুনিক নাগরিক জীবনে নাগরিকদের বহুমুখী দায়িত্ব (সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক প্রভৃতি) পালন করতে হয়। আবার নাগরিকতার সামাজিক ও রাজনৈতিক দিকের স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রূপ রয়েছে। নাগরিক জীবনের এ সবগুলো রূপই পৌরনীতি পাঠের অন্তর্ভুক্ত। সমাজ ও রাষ্ট্রের সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের (পরিবার, গ্রাম, সমাজ, স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রভৃতি) নীতি, প্রকৃতি, স্বরূপ এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে পৌরনীতি আমাদের জ্ঞান দান করে। এক কথায়, পৌরনীতি আমাদের নাগরিক জীবনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে সাহায্য করে।
পৌরনীতির সংজ্ঞা
এফ. আই, গ্লাউড (F. 1. Gloud) এর মতে- ‘যেসব প্রতিষ্ঠান, অভ্যাস, কার্যাবলি ও চেতনার দ্বারা মানুষ রাষ্ট্রীয় বা রাজনৈতিক সমাজের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন এবং অধিকার ভোগ করতে পারে, তার অধ্যয়নই পৌরনীতি।’
বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বিভিন্নভাবে পৌরনীতির সংজ্ঞা দিয়েছেন। ‘London Country Council’ এর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রভাষক, ই. এম, হোয়াইট (Ebe Minerva White) তার ‘The Philosophy of Citizenship’ গ্রন্থে পৌরনীতিকে সুন্দর ও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তার মতে, ‘পৌরনীতি মানবজ্ঞানের সেই মূল্যবান শাখা যা নাগরিকের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এবং স্থানীয়, জাতীয় ও মানবতার সাথে জড়িত প্রতিটি বিষয় পর্যালোচনা করে।’ (Civics is the branch of human knowledge which deals with everything relating to a citizen- past, present and future; local, national and human)। তিনি আরও বলেছেন, ‘যে শাস্ত্র নাগরিকতার সঙ্গে যুক্ত সব প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করে, তাই পৌরনীতি।’ (Civics is the subject that deals with everything appertaining to citizenship)।
আরও পড়ুন: রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য আলোচনা কর
Webster’s International Dictionary-তে পৌরনীতির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘পৌরনীতি হলো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সেই বিভাগ বা শাখা যা নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্য নিয়ে আলোচনা করে।’ (Civics is that department of political science dealing with the rights and duties of citizens.)। (Webster’s International Dictionary (Second Edition) July-2, 1934, page-492./
Encyclopaedia Britannica– তে পৌরনীতির সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘পৌরনীতিকে সামাজিক বিজ্ঞানের সেই শাখা বলে অভিহিত করা যায়, যেখানে সরকারের সংগঠন ও পদ্ধতি এবং নাগরিকের অধিকার ও কর্তব্যসমূহ আলোচনা করা হয়।’ (Encyclopaedia Britannica, Vol-5, page-734)
পৌরনীতি শাস্ত্রের অন্যতম গবেষক চার্লস ক্লিনটন পিটার্স (Charles Clinton Peters) তার ‘Objectives and Procedures in Civic Education’ (Longmans, Green and Company, England, 1930) গ্রন্থে বলেন, ‘পৌরনীতি হলো সরকারের গঠন ও ক্রিয়া সম্পর্কিত বিস্তারিত পাঠ, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিক জীবন ও আচরণ সহজতর করা।’
ইংরেজ লেখক এবং ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের পথিকৃৎ ফ্রেডরিক জেমস গুন্ড (Frederick James Gould)-এর মতে, ‘পৌরনীতি হচ্ছে প্রতিষ্ঠান, আচরণ ও চেতনার অধ্যয়ন, যার মাধ্যমে একজন নারী বা পুরুষ রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য হিসেবে তার কর্তব্য পালন ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে।’ (Civics is the study of institutions, habits and spirits by means of which a man or woman may fulfil the duties and receive the benefits of memberships in political community) |
পরিশেষে, সংক্ষেপে বলা যায়, জ্ঞানের যে শাখা নাগরিক জীবনের সাথে সম্পর্কিত স্থানীয়, জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করে তাকে পৌরনীতি বলে। পৌরনীতির সংজ্ঞা থেকে নাগরিকতা ও এর সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিচের রেখাচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা হলো: