ন্যায়দর্শন আস্তিক বস্তুবাদী দর্শন। একে আস্তিক দর্শন বলা হয়। কারণ এ দর্শন বেদকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করে। একে বস্তুবাদী দর্শন বলা হয়। কারণ এ দর্শন জ্ঞান নিরপেক্ষ বস্তুর স্বাধীন সত্তা স্বীকার করে। কিন্তু ন্যায়দর্শন বেদকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করলেও স্বাধীন চিন্তা ও বিচারের উপর এ দর্শন প্রতিষ্ঠিত মহর্ষি গৌতম ন্যায় সর্গনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অক্ষপাদ নামেও পরিচিত। তার নামানুসারে তার দর্শনকে অক্ষপাদ দর্শনও বলা হয়। ন্যায় অর্পণের উপর একাধিক রচনা বর্তমান। গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’ই ন্যায় দর্শনের প্রথম রচনা হিসেবে স্বীকৃত। ন্যায়দর্শন প্রধানত যথার্থ জ্ঞানলাভের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করে। কি উপায়ে বা কোন কোন বিধি অনুসরণ করে যুক্তিতর্ক করলে আমরা যথাযথ জ্ঞানলাভ করতে পারি, ন্যায়দর্শন প্রধানত তারই আলোচনা করে। এ কারণে ন্যায়দর্শনকে তর্কশাস্ত্র বা বাগবিদ্যাও বলা হয়।
আরও পড়ুন: চৈতসিকের প্রধান প্রধান বিভাগগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দাও
ন্যায় দর্শনের ষোড়শ পদার্থ
ন্যায় দর্শনের ষোড়শ পদার্থের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জীবকে ষোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করা ন্যায় দর্শনের অন্যতম উদ্দেশ্য। কোন পদ দ্বারা যে অর্থ নির্দিষ্ট হয় তাই পদার্থ। পদার্থসমূহের তত্ত্বজ্ঞানও জীবের মুক্তিলাভের জন্য একান্ত প্রয়োজন। ন্যায় দর্শনের মতে, পদার্থ ষোল প্রকার। নিম্নে’ ষোলটি পদার্থ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল-
১. প্রমাণ: যিনি জ্ঞাতা তাকে বলে প্রমাতা। প্রমাতা যে বিষয় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করে তাকে বলা হয় প্রমেয়। যে প্রণালী দ্বারা যথার্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা জন্মে তাকে প্রমাণ বলে। যা প্রসারকরণ তাই প্রমাণ। প্রমাণ চার প্রকার। যথা: প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান এবং অঙ্গ।
২. প্রমেয়: প্রমাণ বা যথার্থ জ্ঞানের বিষয়ই হল প্রমেয়। ন্যায়দর্শন মতে, প্রমেয় দ্বাদশ প্রকার। যথাঃ আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, বিষয় বা অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, প্রেতৎভাব, ফল, দুঃখ, এবং অপবর্গ।
৩. দৃষ্টান্ত: যে বিষয় সম্পর্কে কারো মতভেদ থাকে না তাকে বলে দৃষ্টান্ত। দৃষ্টান্ত প্রমাণসিদ্ধ। যেমন- কোন স্থানে যা দেখে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারে সেখানে আগুন আছে। তখন দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি জ্বলন্ত চুল্লির উল্লেখ করতে পারেন।
৪. সংশয়: অনিশ্চিত জ্ঞানকে সংশয় বলে। কোন এক সময় কোন বস্তু সম্পর্কে যখন নানা বিপরীত ধর্মের উপস্থিতির কথা চিন্তা করা হয় এবং তাদের নির্ণায়ক কোন বিশেষ ধর্ম সৃষ্ট হয় না তখন মনে সংশয় দেখা দেয়। যেমন- ঈষৎ অন্ধকারে দূর হতে একটি বস্তুকে দেখে মনে হল ঐ বস্তুটি দড়ি হতে পারে আবার সর্পও হতে পারে। ঐ বস্তুটি ঠিক হবে তা নির্ণয় করতে না পারায় বস্তুটির প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে মনে সংশয় দেখা দেয়।
৫. প্রয়োজন: যে উদ্দেশ্যে মানুষ কোন কর্মে প্রবৃত্ত হয় তাকেই বলা হয় প্রয়োজন। উক্ত উদ্দেশ্য দ্বিবিধ সুখ ও দুঃখভাব।
৬. সিদ্ধান্ত: যুক্তিতর্কের সাহায্যে যে বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তাই সিদ্ধান্ত। যেমন- আত্মা একপ্রকার দ্রব্য। এটা তার দর্শনের একটি সিদ্ধান্ত।
৭. অবয়ব: ন্যায়ের অন্তর্গত তর্কবাক্যগুলোকে অবয়ব বলা হয়। ন্যায় দর্শনের মতে, অবয়ব পাঁচ রকমের। যথাঃ প্রতিজ্ঞা, হেতু, উদাহরণ, উপনয়ন ও নির্গমন।
৮. তর্ক: কোন স্বীকৃত সিদ্ধান্তের বিপরীতকে অসম্ভব প্রমাণ করার জনা যে যুক্তি তাকে তর্ক বলা হয়। যেমন- কোন পর্বতে ধূম দেখে সিদ্ধান্ত করা হল যে, ঐ পর্বতে আগুন আছে। কেউ যদি এ সিদ্ধান্তকে অস্বীকার করে তবে তাকে নিম্নোক্ত অনুমানের সাহায্যে বুঝানো যেতে পারে। যথা: পর্বতে যদি আগুন না থাকে তবে মনে করতে হবে যে, আনে ছাড়া ধূম সম্ভব অর্থাৎ, কারণ ছাড়া কার্য সম্ভব। যেহেতু আগুন ধূমের একামাত্র জ্ঞাত কারণ। এ জাতীয় অনুমানকে তর্ক বলে। তর্কের অজ্ঞাত বিষয়কে জানা যায় না, তবে জ্ঞাত বিষয়কে সমর্থন করা যায়।
৯. নির্ণয়: পরস্পর বিরোধী মতবাদকে বিচার করে একটিকে বর্জনপূর্বক অপরটিকে গ্রহণ করার নাম নির্ণয়।
১০. বাদ: কেবলমাত্র সত্যতা নির্ধারণের জন্য যদি কোন বিষয়ে আলোচনা করে নিজ নিজ মত প্রতিষ্ঠা করা হয় তখন তাকে বাদ বলে। এতে বাদি বিবাদি উভয়ই সত্যতা নির্ধারণের চেষ্টা করে। যেমন- ঈশ্বরের স্বরূপ নির্ধারণের জন্য যে আলোচনা তাকে বাদ বলা যেতে পারে।
১১. বিতণ্ডা: যুক্তিতর্কের দ্বারা নিজের মতকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা না করে অপরের মতকে খণ্ডন করার জন্য কাজে তর্ক করাকে বিতণ্ডা বলে।
১২ জল্প: তত্ত্ব নির্ণয়ের প্রতি কোন লক্ষ্য না রেখে কেবল নিজের জয়লাভের জন্য বাকযুদ্ধ করার নামই জল্প। যেমন- উকিলরা মাঝে মাঝে বিচারালয়ে জল্প করে।
১৩. ছল: বক্তা যে অর্থে বাক্য প্রয়োগ করেন প্রতিপক্ষ যখন তার বিপরীত অর্থ কল্পনা করে বক্তার বাক্যে দোষ প্রদর্শন করে তখন একে বলা হয় ছল। যেমন- বক্তা একটি বালকের নতুন একখানা কম্বল দেখে বললেন, বালকটির নবকম্বল। কিন্তু প্রতিপক্ষ বললেন, বালকটির একখানা কম্বল, নয়খানা কম্বল নয়। এখানে বক্তা নব শব্দটিকে যে অর্থে প্রয়োগ করেছেন প্রতিপক্ষ তার বিপরীত অর্থ কল্পনা করেছেন।
১৪. হেত্বাভাস: যা আসলে হেতু নয় অথচ হেতুর মত দেখায় তাকে হেত্বাভাস বলে। দোষযুক্ত হেতুই হেত্বাভাস অনুমান সংক্রান্ত অনুপপত্তি।
১৫. জাতি: ব্যাপ্তির উপর ভিত্তি না করে কেবলমাত্র সাদৃশ্য বা বৈসাদৃশ্যের উপর নির্ভর করে যখন কোন অপ্রাসঙ্গিক যুক্তি প্রদর্শন করা হয় তখন তাকে জাতি বলে। যেমন- শব্দ অনিত্য। কারণ এটা ঘটপটাদির ন্যায় উৎপত্তিশীল। বক্তার এরূপ সিদ্ধান্তকে খণ্ডন করতে প্রতিপক্ষ বললেন, শব্দ নিত্য। কারণ এটা আর্কাশের মত অমূর্ত। এখানে অমূর্তত্ব এবং নিত্যত্বের মধ্যে কোন ব্যাপ্তি সম্পর্ক নেই। কেবল সাদৃশ্যের ভিত্তিতে প্রতিপক্ষ বক্তার সিদ্ধান্ত খণ্ডন করতে চেষ্টা করেছেন। প্রতিপক্ষের এ চেষ্টার নাম জাতি।
১৬. নিগ্রহ স্থান: বিচার নিগ্রহের অর্থাৎ পরাজয়ের স্থান বা কারণকে নিগ্রহ স্থান বলে। অজ্ঞানতা বা ভ্রমাত্মক জ্ঞানই পরাজয়ের কারণ। প্রতিপক্ষের মতকে খণ্ডন করতে না পারা, প্রথমে একরকম প্রতিজ্ঞা করে পরে তা প্রত্যাহার করা, দুষ্ট হেতু প্রয়োগ প্রভৃতি নিগ্রহ স্থান।
উপসংহার
উপরিউক্ত আলোচনা শেষে বলা যায় যে, ন্যায় দর্শনের ষোলটি পদার্থের আলোচনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নৈয়ায়িকেরা এ ষোড়শ পদার্থকে তাদের আলোচনার মূল স্তম্ভ মনে করেন। পদার্থসমূহের জ্ঞান দ্বারাই পরমসত্তার সন্ধান পাওয়া যায়। দেহ, ইন্দ্রিয় এবং ইন্দ্রিয় বিষয়ের বন্ধন হতে আত্মাকে মুক্ত করাই ন্যায় দর্শনের উদ্দেশ্য। দেহ, মন, ইন্দ্রিয় প্রভৃতিকে আত্মারূপে ধারণা করাই হল মিথ্যা জ্ঞান। আত্মার স্বরূপ সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞানের দ্বারা মিথ্যা জ্ঞানকে বিনষ্ট করতে পারলেই আত্মা যুক্ত হবে। এ সবকিছুর জ্ঞানই আমরা পদার্থ জ্ঞান ধারণের মধ্যে পাই।