Home » পারমী কি? থেরবাদ ও মহাযান ধর্মমতে পারমী কয়টি ও কি কি? তাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।

পারমী কি? থেরবাদ ও মহাযান ধর্মমতে পারমী কয়টি ও কি কি? তাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য আলোচনা কর।

by TRI

দুঃখময় সংসার হতে মুক্তির জন্য প্রয়োজন নির্বাণ সাক্ষাত। নির্বাণ সাক্ষাতের জন্য প্রয়োজন অরহত্ব ফল প্রাপ্তি। অরহত্ব ফল প্রাপ্তির জন্য প্রয়োজন পারমী পূর্ণতা। তবে স্বল্প পুন্য সম্পন্ন যেকেহ অরহত্ব ফল লাভ করতে পারলেও বুদ্ধত্ব লাভ করতে পারেনা। সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভের জন্য প্রয়োজন দশ পারমী, দশ উপ- পারমী, দশ-পরমার্থ পারমীর পরিপূর্ণতা। বোধিসত্ত্বগণের এই ত্রিংশতি প্রকার পারমী পরিপূর্ণ হলেই তাঁরা সর্বজ্ঞতা জ্ঞানকে ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন করেন এবং এ জ্ঞানকে জনসমক্ষে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁদের শরীরে বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষ লক্ষণ, অশীতি অনুব্যঞ্জন, ষড়রশ্মি সহ অন্যান্য গুণাবলী প্রকাশিত হয়।

পারমী শব্দের অর্থ

‘পারমী’ পরম শব্দ থেকে আগত। পরম অর্থ পরিপূর্ণ, শ্রেষ্ঠ, সর্বাতীত, উৎকৃষ্ট ইত্যাদি। সুতরাং পারমী শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত, পরিপূর্ণ ভাব, পরিপূর্ণ অবস্থা। এখানে পরিপূর্ণ মানে পুণ্যের পরিপূর্ণতা। ‘বুদ্ধবংশে’ বোধিসত্ত্বের পারমীকে বোধিপাচনা ধম্মা’ বা ‘বুদ্ধকারক ধর্ম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

আরও পড়ুন:   যোগাচারবাদ কি? যোগাচারবাদের স্বরূপ সংক্ষেপে বর্ণনা কর

থেরবাদ ও মহাযান ধর্মমতের পারমী সমূহের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য

বর্তমান বিশ্বে বৌদ্ধগণ প্রধান দুই নিকায় বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত। যথা- থেরবাদ ও মহাযান। থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্মে পারমী দশ প্রকার আর মহাযান ধর্মমতে পারমী ছয় প্রকার। নিচে মহাযান ধর্মের পারমী সমূহকে ভিত্তি করে এদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য সমূহ আলোচনা করা হলো-

১. দান পারমীঃ– নিঃস্বার্থ ভাবে অপরকে যা প্রদান করা হয় তাই দান। ধন-জন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, দেহ, রক্ত, মস্তক পর্যন্ত সব কিছুর প্রতি মমতা পরিত্যাগ করে সমাগত যাচকদিগকে অধোমুখী জল কলসীর ন্যায় নিঃশেষ করে দান পূর্বক দান পারমী পূর্ণ করতে হয়। দান পারমী মহাযান ধর্মে যেমন থেরবাদ ধর্মেও তেমন। তাই এতে সাদৃশ্য ব্যতীত বৈসাদৃশ্য নেই।

২. শীল পারমীঃ– শীল হচ্ছে স্বভাব, চরিত্র, সদাচার ইত্যাদি। গৃহীদের প্রতিপাল্য পঞ্চশীল, অষ্টশীল, দশ সুচরিত শীল, মিথ্যাজীব শীল; প্রব্রজ্জিতের দশ শীল, ভিক্ষুদের প্রাতিমোক্ষ সংবর, ইন্দ্রিয় সংবর, আজীব পরিশুদ্ধি প্রত্যয়, সন্নিশ্রিত শীলাদি ভূমিতে স্থিত থেকে সর্বদা অখণ্ডভাবে শীলসমূহ রক্ষা করেই শীল পারমী পূর্ণ করতে হয়। মহাযান ধর্মের শীল পারমীর সাথে থেরবাদের নৈষ্ক্রম্য ও সত্য পারমীকেও সংযুক্ত করা হয়েছে। তাই মহাযানের শীল পারমীর সাথে থেরবাদের আরো দুটি যোগ হওয়ায় বৈসাদৃশ্য ব্যাপক হয়। থেরবাদের নৈক্রম্য অর্থ নিষ্ক্রমণ বা বর্হিগমন, প্রস্থান, দ্রুতবেগে নির্গমন ইত্যাদি।

কারাগারে আবদ্ধ বন্ধনজনিত দুঃখে দুঃখিত ব্যক্তি যেমন তথায় চিরকাল বাস করলেও সেখানে থাকতে ইচ্ছা করেনা, মুক্তির চেষ্টা করে; সেরূপ ভবত্রয়কে কারাগারের ন্যায় ভেবে মুক্তির জন্য নৈষ্ক্রম্যাভিমুখী হওয়া এবং সত্য অর্থ প্রকৃত বা যথার্থ। শীল পারমীতে কেবল বিরতির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সত্য পারমীতে এক কথায় স্থিত থাকা বলা হয়েছে অর্থাৎ- বাক্যের সহিত যেন কার্যের মিল থাকে। ঔষধি তারকা সকল সময়ে, সকল দেব-মানুষের জন্য একই গতিপথ অবলম্বন করার ন্যায় আপন গতিপথ হতে বিচ্যুত না হওয়াই সত্য।

৩. ক্ষান্তি পারমীঃ– ক্ষান্তি অর্থ হলো ক্ষমা, সহিঞ্চুতা, তিতিক্ষা, নিবৃত্তি, বিরতি ইত্যাদি। পৃথিবী যেমন শুচি বা অশুচি যেকোন প্রকার বস্তু নিক্ষেপ করলে পৃথিবী তৎপ্রতি ক্রোধ বা দয়া করেনা, সমস্ত নিক্ষেপ সহ্য করে, তেমনি সম্মান-অপমান সমস্ত কিছু নির্বিকার চিত্তে সহ্য করতঃ ক্ষান্তি পারমী পূর্ণ করতে হয়। মহাযানের ক্ষান্তি পারমীর সাথে থেরবাদের ক্ষান্তি পারমীর মধ্যে কোন বৈসাদৃশ্য নেই।

৪. বীর্য পারমীঃ– বীর্য শব্দের অর্থ হলো বীরত্ব, কর্মশক্তি, কার্যারম্ভ। এর কৃত্য হলো বাধার পর বাধা অতিক্রম কর। মৃগরাজ সিংহ যেমন উপবেশন, দাঁড়ান ও পদচারণ এই ত্রিবিধ অবস্থায় অসঙ্কোচিত বীর্য ও প্রসারিত চিত্তে অবস্থান করে, তদ্রুপ সর্বভবে দৃঢ় পরাক্রমশালী হয়ে বীর্য পারমী পূর্ণ করতে হয়। মহাযানীরা বীর্য পারমীর সাথে অনেকে আরো উপায়কৌশল্য, প্রণিধান এবং বল এই তিনটি পারমীর কথাও বলে থাকেন। মহাযানের বীর্য পারমীর সহিত থেরবাদের বীর্য পারমী সহ অধিষ্ঠান পারমীকেও এখানে আলোচনায় নিয়ে এসে সামঞ্জস্য রাখা হয়েছে। অধিষ্ঠান শব্দের অর্থ সর্বদিক প্রভাবান্বিত করে আপন কৃত্যে অবস্থিতি থাকা। অধিষ্ঠান হল দৃঢ় সংকল্পে অটল থাকা। অচল, সুপ্রতিষ্ঠিত শিলাময় পর্বত যেমন প্রবল বাত্যাঘাতেও কম্পিত হয়না, স্বীয় স্থানেই স্থিত থাকে, তদ্রুপ অধিষ্ঠানে শিলাময় পর্বতের ন্যায় সর্বদা নিশ্চল হতে হবে।

৫. ধ্যান পারমীঃ– বীর্য বর্ধিত হলেই সমাধিতে যত্নপর হতে হবে। ধ্যান দ্বারা ক্লেশ সমূহকে ধ্বংস করতে হয়। ধ্যানের অপর নাম সমাধি। সমাধি অর্থ সমাধান। সমাধি অনেক প্রকার হলেও এখানে কেবল লৌকিক সমাধিই অভিপ্রেত। কুশলচিত্ত একাগ্রতাকেই লৌকিক সমাধি বলা হয়। মহাযানের ধ্যান পারমীর সাথে থেরবাদের মৈত্রী এবং উপেক্ষা পারমীকেই সাদৃশ্য মনে হয়। থেরবাদের মৈত্রী পারমীতে বলা হয়েছে যে, বিশ্বের সকল প্রাণীর প্রতি নিজের জীবনের ন্যায় ভালবাসাই হলো মৈত্রী এবং সুখে-দুঃখে, যশে-অযশে, নিন্দায়-প্রশংসায় এবং লাভ-ক্ষতিতে নির্বিকার চিত্তে স্থির থাকাই উপেক্ষা পারমী।

৬. প্রজ্ঞা পারমীঃ– মহাযানীরা প্রজ্ঞা পারমীর সাথে ‘জ্ঞান’ নামেও একটি পারমীর কথা উল্লেখ করেন। তাঁরা আরো বলেন, দানাদি পাঁচ প্রকার পারমী হলো পুণ্য সম্ভার পূর্ণতার জন্য এবং প্রজ্ঞা পারমী সর্বজ্ঞতা লাভের জন্য। প্রজ্ঞা শব্দের অর্থ হলো সম্যক চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে বিষয়বস্তুকে প্রকৃষ্টরূপে জ্ঞাত হওয়া। চিন্তন, মনন ও পঠন-পাঠনের প্রজ্ঞা প্রকৃত প্রজ্ঞা নয়; ধ্যান সমাপত্তি বা ফল সমাপত্তি দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান বা প্রজ্ঞাই হলো প্রকৃত প্রজ্ঞা বা ভাবনাময়ী প্রজ্ঞা। বুদ্ধবংশ গ্রন্থ মতে, “ভিক্ষু যেমন ভিক্ষা করার সময় হীন, উৎকৃষ্ট, মধ্যম কোন কুল বাদ না দিয়ে যাপনযোগ্য আহার মাত্র লাভ করে; সেরূপ সর্বদা পন্ডিত ব্যক্তির নিকট মহাশয় কুশল কি? অকুশল কি? কর্তব্য কি? অকর্তব্য কি? ইত্যাদি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা দ্বারা প্রজ্ঞা পারমী পূর্ণ করতে হয়।” মহাযানের প্রজ্ঞা পারমীর সাথে থেরবাদের প্রজ্ঞা পারমীর মধ্যে বিশদ বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়না।

উপসংহার

পৃথিবীতে সমস্ত মানুষ সমান পুণ্যের অধিকারী না হলেও কিন্তু সমস্ত বুদ্ধের পুণ্য, গুণ সমান সমান। তাই বুদ্ধ ব্যতীত তাঁর শিষ্যগণ সবাই পুণ্যে, পারমীতে সমান নহে বিধায় অর্হত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হয়েও কেহ শুষ্ক বিদর্শক, কেহ ত্রিবিদ্যাধারী, কেহ ষড়াবিজ্ঞা, কেহ প্রতিসম্ভিদা জ্ঞানের অধিকারী। তদুপরি পারমী ধর্মের তারতম্যের কারণে বুদ্ধের অশীতি মহাশ্রাবক আশি গুণে গুণান্বিত হন। অপরদিকে বুদ্ধ যেহেতু প্রজ্ঞা লাভের সমস্ত পারমী পূর্ণ করেছেন, সেহেতু তিনি সর্বজ্ঞতা জ্ঞানের অধিকারী। সুতরাং আমাদের জ্ঞানের তারতম্যের নিরিখে পুণ্য পারমী পূরণের বিষয়টি এক অনস্বীকার্য বিষয়।

Related Posts

1 comment

আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই দুঃখ মুক্তির পথ স্বরূপ। - কেন? December 6, 2023 - 11:21 am

[…] পারমী কি? থেরবাদ ও মহাযান ধর্মমতে পারম… […]

Comments are closed.