বর্তমান বিশ্বের সংবিধানগুলোর মধ্যে ব্রিটেনের সংবিধানই সর্বাপেক্ষা প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবিধানের উপর এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব বিরাজমান। আজ এই আর্টিকেলের মাধ্যমে জানবো পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন গণতান্ত্রিক সংবিধান ব্রিটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্য সমূহ। আশাকরি, আর্টিকেলটি আপনাদের অনেক উপকারে আসবে।
ব্রিটিশ সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
ব্রিটিশ সংবিধানের কার্যকারিতা, শাসনব্যবস্থার স্বরূপ ইত্যাদি বিচার করে নিম্নে ব্রিটেনের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো-
১. অলিখিত সংবিধান
ব্রিটিশ সংবিধান প্রধানত অলিখিত এবং এর উপাদানসমূহ প্রথা, রীতিনীতি ও ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। তাই টমাস পেইন একে সংবিধান বলতে নারাজ। ফরাসি ঐতিহাসিক টকভিল বলেছেন, “ব্রিটিশ সংবিধানের কোন অস্তিত্বই নেই।” অবশ্যই পৃথিবীর কোন সংবিধানই সম্পূর্ণ লিখিত নয়। লিখিত ও অলিখিত অধ্যায়ের সমন্বয়েই সংবিধান গঠিত হয়। এখানেও কিছু কিছু লিখিত উপাদান রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১২১৫ সালের ম্যাগনাকার্টা, ১৬২৮ সালের পিটিশন অব রাইটস, ১৬৮৯ সালের বিল অব রাইটস, ১৭০১ সালের অ্যাক্ট অব সেটেলমেন্ট ও পরবর্তী সময়ের প্রতিনিধি আইনসমূহ ব্রিটিশ সংবিধানের স্তম্ভস্বরূপ।
২. ধারাবাহিকতা ও বিবর্তনশীলতা
ব্রিটিশ সংবিধান একদিনে বা একটি নির্দিষ্ট সময়ে তৈরি হয় নি অথবা কোন মতবাদ হতেও এর উৎপত্তি হয় নি। যুগ যুগ ধরে স্বাভাবিক নিয়মে বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে বর্তমান রূপলাভ ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে, ব্রিটিশ সংবিধান ধীর, স্থির ও মন্থরগতিতে পরিবর্তিত হতে হতে বর্তমান রূপ লাভ করেছে।
৩. নমনীয়
এ সংবিধান অত্যন্ত নমনীয়। কেননা, প্রয়োজন অনুসারে আইন প্রবর্তনের পদ্ধতিতেই একে পরিবর্তিত করা চলে। এতে কোন জটিলতার সৃষ্টি হয় না। শাসনতান্ত্রিক আইন ও সাধারণ আইনের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তবে মতবাদের দিক থেকে ব্রিটেনের সংবিধানকে নমনীয় বললে কার্যত ইংরেজদের রক্ষণশীলতার জন্য এটি তেমন সুপরিবর্তনীয় নয়।
আরও পড়ুন: ব্রিটিশ সংবিধানের উৎস সমূহ কি কি?
৪. এককেন্দ্রিক সংবিধান
ব্রিটেনের সংবিধান আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ন্যায় বা কানাডার ন্যায় যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়। একমাত্র কেন্দ্রীয় সরকার রাষ্ট্রের সমুদয় শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করে। রাজা ও পার্লামেন্ট রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। স্বায়ত্তশাসিত কাউন্টি বা বারো প্রভৃতি কতকগুলো স্থানীয় সরকার আছে এবং এদের কিছু ক্ষমতাও আছে। তবে এদের অস্তিত্ব পুরোপুরি কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।
৫. নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র
ব্রিটেনে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র সমাসীন রয়েছে। রাজা এখানে নামমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। প্রকৃত প্রস্তাবে তার ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত। তাই ব্রিটেনের রাজা বা রাণীর ক্ষেত্রে বলা যায়, “The king reigns but does not govern.”
৬. প্রথার প্রাধান্য
ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য প্রথার প্রভাব। বিভিন্ন পর্যায়ের হাজারো প্রথায় ব্রিটিশ সংবিধানকে সমৃদ্ধ করেছে। প্রথার প্রভাবের ফলে এ সংবিধান মূলত অলিখিত সংবিধানে রূপান্তরিত হয়েছে।
৭. পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব
ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্ব। পার্লামেন্টের উপর কোন আইনগত বাধানিষেধ আরোপ করা যায় না। পার্লামেন্ট যেকোন আইন প্রণয়ন, সংশোধন বা বাতিল করতে পারে। আদালত পার্লামেন্টের সব আইনকেই বৈধ বলে প্রয়োগ করে।
৮. দুর্বল বিচার বিভাগ
মার্কিন সুপ্রীম কোর্ট সংবিধান বিরোধী এবং ন্যায়নীতি বিরোধী যে কোন আইনকে বাতিল করে দিয় সংবিধানের পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখে। কিন্তু বিটেনের বিচার বিভাগ পার্লামেন্ট প্রণীত আইনের ব্যাখ্যা করতে পারলেও তার বৈধতা বিচার করতে পারে না। তাই ব্রিটেনের বিচার বিভাগকে দুর্বল বিচার বিভাগ বলে অভিহিত করা হয়।
৯. মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার
ব্রিটিশ সরকার যথার্থই মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ ব্রিটেনের নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে। কমন্স সভার আস্থাভাজন হয়ে এটি ক্ষমতা প্রয়োগ করে। পার্লামেন্টের নিকট আস্থা হারালে মন্ত্রিপরিষদ ক্ষমতাচ্যুত হয়।
১০. ক্ষমতার সহযোগিতা
ব্রিটেনের শাসনতন্ত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় নি, যদিও সরকারের বিভিন্ন বিভাগে কিছু কিছু ক্ষমতা বণ্টন করা হয়েছে। স্বতন্ত্রীকরণের পরিবর্তে এখানে সহযোগিতার মন্ত্রই উচ্চারিত হয়েছে।
১১. আইনের শাসন
ব্রিটেনের সংবিধানের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল আইনের শাসন বা আইনের প্রাধান্য। ব্রিটেনের জনসাধারণ বিধিবদ্ধ আইন দ্বারা শাসিত হয়। নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানই হল আইনের শাসনের মূলকথা।
১২. সুপরিবর্তনীয় সংবিধান
ব্রিটেনের সংবিধান সুপরিবর্তনীয়। এরূপ সংবিধান সংশোধন বা পরিবর্তন সাধনের জন্য বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বনের প্রয়োজন নেই। সাধারণ আইন প্রণয়নের পদ্ধতিতেই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এ শাসনতন্ত্রের পরিবর্তন সাধন করতে পারে।
১৩. সহিষ্ণুতা
ব্রিটিশ সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সহিষ্ণুতা। বলতে গেলে সমগ্র সংবিধানটিই জনগণের সহিষ্ণুতার উপর ভিত্তি করে টিকে আছে। জনগণের সহিষ্ণুতা ছাড়া ব্রিটিশ শাসনতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হতো না।
১৪. দলীয় ব্যবস্থা
দলীয় ব্যবস্থা ব্রিটেনের শাসনব্যবস্থা ও রাজনীতির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তবে এখানে পার্লামেন্ট প্রণীত কোন আইনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে নি। গণতান্ত্রিক চিন্তাধারা এবং প্রতিষ্ঠানের বিকাশের সাথে সঙ্গতি রেখে দলীয় ব্যবস্থার উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছে।