উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি হতে পারে, কেন একটি সংবিধানকে উত্তম সংবিধান বলা হবে, বা কি কি বৈশিষ্ট্য থাকলে একটা সংবিধানকে উত্তম সংবিধান বলা যাবে, সেসব বিষয় নিয়েই আজকের এই আর্টিকেলটি।
উত্তম সংবিধানের বৈশিষ্ট্য
সংবিধানকে দর্পনের সাথে তুলনা করা যায়। দর্পনে যেমন মানুষের চেহারা স্পষ্ট হয়ে উঠে, তেমনি সংবিধানের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্রের চরিত্র ফুটে উঠে। যে দেশের শাসনতন্ত্র যত উন্নত এবং আদর্শমুখী সে দেশ ও জাতি তত উন্নত। যেসব বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে একটি দেশের সংবিধানকে উত্তম সংবিধান বলা যায় তা আলোচনা করা হল-
১. সুস্পষ্টতা
শাসনতন্ত্রের নীতি ও ধারাসমূহ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট এবং সুনিশ্চিত হওয়া আবশ্যক যাতে তার অর্থ সম্পর্কে দ্বিমত দেখা না দেয়। সুতরাং, সে শাসনতন্ত্রই উত্তম বলে বিবেচিত হবে যা দ্ব্যর্থ পূর্ণ ভাষা ও শব্দ পরিহার করে প্রাঞ্জল এবং অর্থপূর্ণ ভাষায় রচিত।
২. সংক্ষিপ্ততা
সংবিধানের বিভিন্ন ধারা ও উপধারা সংক্ষিপ্ত হওয়া বাঞ্ছনীয় যাতে তার মধ্যে অযথা অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গের অনুপ্রবেশ না ঘটে। তবে সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন রাষ্ট্রের গঠন এবং কিভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিচালিত হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত ব্যবস্থার উল্লেখ থাকতে হবে।
৩. মৌলিক অধিকারের অন্তর্ভূক্তি
সংবিধানে জনগণের মৌলিক অধিকারসমূহ অন্তর্ভূক্তি থাকা আবশ্যক। শাসন বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করতে চাইলে জনগণ সরকারের বিরুদ্ধে শাসনতন্ত্র ভঙ্গের অভিযোগ আনয়ন করতে পারে। ফলে সরকারের স্বৈরাচারী প্রবণতা রুদ্ধ হয়, জনগণের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে।
আরও পড়ুন: সংবিধান প্রণয়নের পদ্ধতি সমূহ আলোচনা কর
৪. সময়োপযোগিতা
উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। শাসনতন্ত্রকে অবশ্যই জনগণের এ পরিবর্তিত চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলতে হবে। অন্যথায়, শাসনতান্ত্রিক বিধিবিধান ও উদ্দেশ্যের সাথে জনগণের ইচ্ছার দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা দিবে।
৫. সার্বভৌম ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা
এটা উত্তম সংবিধানের অপর একটি বৈশিষ্ট্য। উত্তম সংবিধানে রাষ্ট্রের আইনগত সার্বভৌমত্ব ও সরকার এবং রাজণৈতিক সার্বভৌমত্ব অর্থাৎ, জনগণের মধ্যে ভারসাম্য থাকা একান্ত আবশ্যক। অন্যথায়, বিপ্লব ও গণঅভ্যুত্থানের ভয় থেকে যায়।
৬. ঐতিহ্য এবং জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি
সংবিধানকে অবশ্যই সামাজিক ঐতিহ্য এবং জাতীয় আকাঙ্ক্ষার প্রতিচ্ছবি হতে হবে। কেননা সংবিধানের মাধ্যমেই একটি দেশ ও জাতির পরিচয় লাভ করা যায়। এর মাধ্যমেই জাতির স্বকীয়তা ও মৌলিকতা ফুটে উঠে।
৭. সহজ সংশোধন পদ্ধতি
উত্তম সংবিধানকে অবশ্যই একটি সহজ সংশোধন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। তবে এমন সহজসাধ্য হওয়া উচিত নয়, যাতে অহেতুক পরিবর্তনের সুযোগ থাকে।
আরও পড়ুন: সংবিধানের উৎস সমূহ আলোচনা কর
৮. লিখিত রূপ
উত্তম সংবিধান লিখিত হবে বলেই প্রত্যাশা করা হয়। শাসনব্যবস্থার স্থিতিশীলতা, নাগরিকদের অধিকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রদেশগুলোর অধিকার রক্ষার জন্য লিখিত সংবিধানই কামনা করা হয়।
৯. জনমতের অগ্রাধিকার
উত্তম সংবিধান জনমতের প্রতিফলন ঘটায়। উত্তম সংবিধান হবে জনমতের ধারক ও বাহক। জনমতের প্রতি লক্ষ্য রেখেই সংবিধান পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত হয়ে যুগোপযোগী হবে।
১০. বিচার বিভাগের প্রাধান্য
সংবিধানের প্রাধান্য সুনিশ্চিত করার জন্য বিচার বিভাগের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য বিচার বিভাগের হাতে সংবিধানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা প্রদান করতে হবে। বিচার বিভাগ হবে সংবিধানের রক্ষক ও অভিভাবক।
১১. জাতীয় আদর্শ ও লক্ষ্যের সন্নিবেশ
উত্তম সংবিধানে জাতির আদর্শ ও লক্ষ্যের সন্নিবেশ থাকা উচিত। এতে সরকার যেমন জাতির জন্য কাজ করতে পারে তেমনি জনগণও আদর্শের বলে বলীয়ান হবে।
১২. উত্তম পরিবর্তন পদ্ধতি
উত্তম সংবিধানের পরিবর্তন পদ্ধতি খুব সহজও হবে না আবার খুব জটিলও হবে না। সংবিধানের পরিবর্তন যদি খুব সহজ হয় তাহলে শাসনতান্ত্রিক আইন ও সাংবিধানিক আইনের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা খুবই কষ্টকর হবে। আবার সংবিধান খুব বেশি দুষ্পরিবর্তনীয় হলে সমাজের পরিবর্তনের সাথে তাল রক্ষা করে চলতে পারবে না।
১৩. ক্ষমতা বণ্টন
উত্তম সংবিধানে সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে দায়িত্ব ও ক্ষমতা বণ্টন করে দেওয়া হয়। ফলে এক বিভাগ অন্য বিভাগের উপর কর্তৃত্ব করতে পারে না। উত্তম সংবিধানের বিভিন্ন বিভাগকে স্বৈরাচারী প্রবণতার হাত থেকে রক্ষা করে নিজ অধিকার ও দায়িত্ব অনুযায়ী পরিচালিত হতে সাহায্য করে।
১৪. জরুরি অবস্থার উপযোগী
জরুরি অবস্থা মোকাবিলার ক্ষেত্রে উত্তম সংবিধানকে অত্যধিক উপযোগী হতে হবে। একটি উত্তম সংবিধানের জন্য উল্লিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো থাকা আবশ্যক। কোন দেশের সংবিধানে যদি উক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান না থাকে তবে তাকে উত্তম সংবিধান বলা যাবে না।