Home » জন লকের সম্মতি তত্ত্ব আলোচনা কর

জন লকের সম্মতি তত্ত্ব আলোচনা কর

by TRI

বিখ্যাত ইংরেজ দার্শনিক জন লকের সম্মতি তত্ত্ব একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। তিনি তাঁর বিখ্যাত “Two Treaties of Civil Government” গ্রন্থে সম্মতি তত্ত্ব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এ তত্ত্বের মধ্যে লকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তর পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর সম্মতি তত্ত্বের ৯৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যক্তির সম্মতিটাই আসল, সম্মতি না নিয়ে কোনো কিছু করা চলবে না। সুতরাং, আধুনিক রাষ্ট্রদর্শনে জন লকের সম্পতি তত্ত্ব যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবাদন এতে কোন সন্দেহ নেই।

জন লকের সম্মতি তত্ত্ব

সম্মতি বলতে সাধারণত কোন কাজ করার বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বা ব্যক্তিবর্গের হ্যাঁ বা না সূচক মনোভাবকে বুঝায়। কিন্তু সম্মতি শব্দটিকে লক তাঁর রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্র ও সরকার গঠনের ক্ষেত্রে শাসিত জনগণের হ্যাঁ বা না সূচক মনোভাব প্রকাশের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। 

লকের মতে, প্রকৃতির রাজ্যে কতিপয় স্বার্থপর ব্যক্তি অন্য ব্যক্তিদেরকে তাদের বিভিন্ন অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করত। এ কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঞ্চনার হাত থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য রাষ্ট্র গঠন ও প্রাকৃতিক অধিকারের প্রশ্নে সম্মতি দান করে।

লক সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, শাসিত জনগণের সম্মতি ছাড়া শাসন ক্ষমতােই অধিষ্ঠিত কোন সরকারই বৈধ নয়। তিনি আরও বলেছেন, একমাত্র শাসিতের সম্মতিই সরকারকে বৈধ করে তোলে এবং এটাই একমাত্র রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তি হতে পারে।

আরও পড়ুন:  জন লকের সম্পত্তি তত্ত্ব আলোচনা কর

লকের সম্মতি তত্ত্বের প্রকারভেদ

সম্মতি তত্ত্ব জন লকের রাষ্ট্রদর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি এ তত্ত্বের মাধ্যমে জনগণকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। লক সম্মতিকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- ক) প্রকাশ্য সম্মতি (Express Consent) এবং খ) অপ্রকাশ্য বা মৌন সম্মতি (Tacit Consent)। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-

ক) প্রকাশ্য সম্মতি

প্রকৃতির রাজ্যের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিংবা প্রকৃতির রাজ্যে মানুষ সম্পত্তির যে অধিকার ভোগ করে সে অধিকারকে নিশ্চিত বা নিরাপদ করার জন্য রাষ্ট্র বা সরকারের প্রয়োজন। যে সম্মতির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্র বা সরকার গঠন করে তাকে প্রকাশ্য সম্মতি বলা হয়।

খ) অপ্রকাশ্য বা মৌন সম্মতি

অপ্রকাশ্য বা মৌন সম্মতি হল জন লকের দ্বিতীয় ভাগের সম্মতি। এক্ষেত্রে জনগণের সম্মতি অপ্রকাশ্য থাকে। অপ্রকাশ্য বা মৌন সম্মতি এমন এক প্রকারের সম্মতি যেখানে সম্মতি দাতা বুঝতে পারে না তার সম্মতি প্রদানের কথা। লকের মতে, মৌন সম্মতির উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র মানুষের যে কোন অধিকারকে স্পর্শ করতে পারে।

লকের সম্মতি তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য

জন লকের সম্মতি তত্ত্ব বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলো ফুটে উঠে-

১. নাগরিকের মতামত

জন লকর সম্মতি তত্ত্বের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল নাগরিকের মতামত। নাগরিকের সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রীয় কল্যাণ আসতে পারে না। যে সরকার নাগরিকদের সম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় লকের মতে সে সরকার নাগরিকদের আনুগত্য দাবি করতে পারে না।

২. স্বৈারাচার বা স্বেচ্ছাচারের অবসান

লক সম্মতি তত্ত্ব ঘোষণা করে চরম রাজতন্ত্র ও স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটাতে চেয়েছিলেন। মালিকের সম্মতি ছাড়া সম্পত্তির উপর হস্তক্ষেপ করা চলবে না, সম্মতি ছাড়া রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপিত হতে পারে না ইত্যাদি কথাগুলো বলে তিনি স্বৈরাচারী রাজার বিরুদ্ধে মনোভাব পোষণ করেছিলেন। স্বৈরাচারিতাকে তিনি ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিপন্থি বলে মনে করতেন।

৩. চিরস্থায়ী বন্ধন

জন লকের সম্মতি তত্ত্বের চিরস্থায়ী বন্ধন একটি উল্লেখযোগ্য দিক। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “যারা প্রকাশ্য ঘোষণার মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠনের সম্মতি প্রদান করেছে তারা চিরস্থায়ী ও অপরিহার্যভাবে রাষ্ট্রের সাথে আনুগত্যের বন্ধনে আবদ্ধ।”

৪. সম্পত্তি ভোগ

সম্পত্তি ভোগের মাধ্যমে জনগণ সরকারের প্রতি সম্মতি প্রদান করে। লকের মতে, যারা রাষ্ট্রীয় অধীনে সম্পত্তি ভোগ করে তারা সম্মতি প্রদানের মাধ্যমে তা করে থাকে। কেননা, সম্মতি প্রদান না করলে তার কাছ থেকে রাষ্ট্র বা সরকার কোন আনুগত্য দাবি করতে পারে না।

৫. প্রকাশ্যতা

প্রকাশ্যতা জন লকের সম্মতি তত্ত্বের একটি বিশেষ দিক। তিনি জনগণকে প্রকাশ্যভাবে মতামত প্রদানের ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন। জনগণ তার প্রয়োজনে সরকারের প্রতি প্রকাশ্য সম্মতি প্রদান করতে পারবে। এ সম্মতির অধিকারের মতই প্রকা-সামাজিক বা প্রাক-রাষ্ট্রীয়।

৬. প্রাকৃতিক অধিকার

জন লক সম্মতিকে “জনগণের প্রাকৃতিক অধিকার” বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর সম্মতি তত্ত্বের সর্বাপেক্ষা প্রতিফলন ঘটেছে প্রাকৃতিক অধিকারের ক্ষেত্রে। জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতাকে তিনি প্রাকৃতিক অধিকার বলে চিহ্নিত করেছেন। 

৭. রাজনৈতিক অধিকার

জন লক সম্মতি তত্ত্বকে একটি রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সম্মতির অধিকার প্রকারে মাধ্যমে রাজনৈতিক অধিকারকে সংরক্ষণ করা যায়। মানুষ পুরোপুরি রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে থাকে। এ অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা সম্ভব নয়।

Related Posts