এরিস্টটল এর বিপ্লব তত্ত্ব
এরিস্টটল তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “The Republic”-এ বিপ্লব তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। এর পঞ্চম অধ্যায় বিপ্লব সম্পর্কিত মতবাদের ব্যাখ্যা ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিপ্লব প্রতিকারের উপায়সমূহ নির্দেশ করেছেন।
এরিস্টটল যে বিপ্লব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন তা ফরাসি বিপ্লব বা রুশ বিপ্লবের ন্যায় রক্তাক্ত বা সশস্ত্র কোন বিপ্লব নয়। বিপ্লব শব্দটি তিনি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছন। তার ফলে যে কোন রকমের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিপ্লবের অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
গণতন্ত্র, ধনিকতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের যে কোন পরিবর্তন, সংবিধানের যে কোন সংশোধন, কিংবা এক শ্রেণীর শাসক কর্তৃক আরেক শ্রেণীর শাসককে উচ্ছেদ করা ক্ষমতা গ্রহণ বিপ্লবের অন্তর্ভূক্ত। এককথায়, সরকার বা সংবিধানের যে কোন পরিবর্তনকেই তিনি বিপ্লবের আওতাভূক্ত করেছেন।
বিপ্লব সম্পর্কে এরিস্টটল বলেছেন যে, বিপ্লব বিভিন্ন উপায়ে সংঘটিত হয়। যেমন- সাংবিধানিক পরিবর্তনের ফলে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে। অথবা বিপ্লবীরা সংঘটিত হতে পারে। অথবা বিপ্লবীরা সংবিধানের কোন রকম পরিবর্তন ছাড়াই রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করতে পারে। আবার সমস্ত সরকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিপ্লব না ঘটিয়ে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোন নির্দিষ্ট সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধেও বিপ্লব ঘটতে পারে। তাছাড়া বিপ্লব সম্পূর্ণ, আংশিক এবং সশস্ত্র কিংবা শান্তিপূর্ণ হতে পারে।
আরও পড়ুন: এরিস্টটল এর দাস প্রথা আলোচনা কর
এরিস্টটলের মতে বিপ্লবের কারণ সমূহ
এরিস্টটল বিপ্লবের কারণসমূহকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন। যথা- ক. সাধারণ কারণ এবং খ. বিশেষ কারণ।
ক. বিপ্লবের সাধারণ কারণ
এরিস্টটল বিপ্লবের কতকগুলো সাধারণ কারণ নির্ণয় করেছেন। এগুলো হলো-
১. ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য: রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ব্যাপক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে।
২. সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার: সরকারি কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণেও রাষ্ট্রে বিপ্লব সংঘটিত হতে পারে।
৩. মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনুপস্থিতি: সমাজে স্থায়িত্ব এবং ভারসাম্য রক্ষাকারী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আকার ছোট হলে কিংবা মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনুপস্থিতির জন্যও বিপ্লব হতে পারে।
৪. চরমপন্থিদের কারণে: সমাজে চরমপন্থিদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পেলেও বিপ্লব হতে পারে।
৫. সুযোগ সুবিধার অসম বণ্টন: সমযোগ্যতার ভিত্তিতে অসম সুযোগ সুবিধা বণ্টিত হলে বিপ্লব হতে পারে।
৬. সাম্প্রদায়িক কোন্দল: দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা কোন্দল দেখা দিলে বিপ্লব হতে পারে।
৭. রাজনৈতিক কারণে দল বা গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব: পদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন দল, উপদল বা গোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দ্বের ফলে বিপ্লব দেখা দিতে পারে।
৮. সম্পদের অসম বণ্টন: রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টন থাকলে বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়ে।
খ. বিপ্লবের বিশেষ কারণ
বিপ্লবের সাধারণ কারণগুলো নির্ধারণের পর এরিস্টটল বিপ্লব সম্পর্কে কতকগুলো বিশেষ কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। এগুলো হলো-
১. জনমনে চরম অসন্তোষ: শাসক শ্রেণীর অত্যধিক ধনলিপ্সার ফলে জনগণেরে মনে অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। এ অসন্তোষ যখন চরম আকার ধারণ করে তখনই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়।
২. অন্যায়ভাবে সম্মান প্রাপ্তির ইচ্ছা: অন্যায়ভাবে সম্মান প্রাপ্তির ইচ্ছা বিপ্লবের আরেকটি নির্দিষ্ট কারণ। রাষ্ট্রের যোগ্য ব্যক্তি যখন উপযুক্ত সম্মান লাভ থেকে বঞ্চিত হয় এবং অযোগ্য ব্যক্তিরা তা লাভ করে, এরূপ অবস্থা বিপ্লবের সূচনা করে।
৩. শাসকদের বিভিন্ন অংশের চক্রান্ত: শাসকদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে চক্রান্তের ফলেও বিপ্লব ঘটতে পারে।
৪. দুর্নীতিমূলক কাজ ও ভয়ভীতি: ভয়ভীতি থেকেও অনেক সময় বিপ্লবের সূত্রপাত হয়। দুর্নীতিমূলক কাজের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা শাস্তি ভোগের ভয় থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রে বিপ্লব আনয়ন করতে পারে।
৫. রাষ্ট্রের কোন অঞ্চলের অস্বাভাবিক প্রসার ও সমৃদ্ধি: কোন অঞ্চলের অস্বাভাবিক প্রসার বিপ্লব ঘটতে সহায়তা করে। এরিস্টটল এর মতে, মানবদেহের বিভিন্ন অংশ অসামঞ্জস্যপূর্ণ হলে যেমন এর সঠিক কার্যকারিতা বিনষ্ট হয়; ঠিক তেমনি রাষ্ট্রের কোন একটি অঞ্চল অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি সমৃদ্ধশালী হলেও রাষ্ট্রে বিপ্লব দেখা দেয়।
৬. রাজনৈতিক কলহ ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা: রাজনৈতিক কলহ এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য সংঘর্ষের সৃষ্টি হয় এবং এ অবস্থা বিপ্লবের পথকে সুগম করে।
৭. শাসকের অসতর্কতা: শাসকের অসতর্কতা হেতু বিপ্লবের সূচনা হতে পারে।
৮. তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিপ্লব: অনেক সময় নিতান্ত ছোটখাট ঘটনা থেকেও বিপ্লবের সূত্রপাত ঘটতে পারে। প্রাচীনকালে সিরাকিউসে দু’জন যুবকের প্রেমঘটিত ব্যাপার নিয়েই বিপ্লবের সূত্রপাত হয়েছিল। আবার হেলেনকে কেন্দ্র করে ট্রয় নগরী ধ্বংস হয়েছে।
এরিস্টটলের মতে বিপ্লব প্রতিকারের উপায় সমূহ
কিভাবে বিপ্লব প্রতিকার করে সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষা করা যায় সে সম্পর্কেও এরিস্টটল আলোচনা করেছেন। নিম্নে এরিস্টটলের বিপ্লব তত্ত্ব মতে বিপ্লব প্রতিকারের উপায় সমূহ তুলে ধরা হলো-
১. আইন মেনে চলার উপযুক্ত ব্যবস্থা: রাষ্ট্রের আইন যাতে জনগণ মেনে চলে তার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
২. গুণীব্যক্তির স্বীকৃতি ও বিরোধীদের অবিচার না করা: যাদের হাতে শাসন ক্ষমতা নেই তাদের ওপর যেন অবিচার না করা হয় এবং বিশেষত তাদের মধ্যে যে গুণীব্যক্তি তার প্রতিভার উপযুক্ত স্বীকৃতি যেন দেওয়া হয়।
৩. দেশপ্রেম সৃষ্টি করা ও শাসকদের কূটকৌশল: দেশবাসীকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজন হলে শাসকগণ দেশবাসীকে মিথ্যা বিপদের ভয় দেখিয়ে সন্ত্রস্ত রাখবেন যাতে দেশ রক্ষা কার্যে তারা বিনিদ্র প্রহরীর ন্যায় সদা সতর্ক থাকে।
৪. সুনির্দিষ্ট শাসনকাল ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ: মর্যাদাগত অসাম্যের দরুন নাগরিকগণের মধ্যে যে বিদ্বেষ সৃষ্টি হয় তা দমন করা আবশ্যক। এজন্য শাসনব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন শাসকগণ অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে না পারে। সে উদ্দেশ্যে শাসকের কার্যকলাপ সীমিত করতে হবে। বিশেষ ব্যক্তি বা দল অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রীয় সম্মানে ভূষিত হয়ে যাতে অত্যন্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠতে না পারে সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
৫. শাসনব্যবস্থার অনুকূল শিক্ষাব্যবস্থা: শাসনব্যবস্থার প্রকৃতি অনুযায়ী দেশের শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন করা প্রয়োজন এবং নাগরিকগণ বাল্যকাল থেকে যাতে রাষ্ট্রের শাসনব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয় সেরূপ শিক্ষা তাদের দিতে হবে।