দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ ধ্বংসাত্মক তাণ্ডবলীলা এবং সৃষ্ট মানবতার বিপর্যয় বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে শান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। ফলে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নানা পদক্ষেপ গৃহীত হয় এবং লীগ অব নেশনস-এর ধ্বংসস্তূপের উপর জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠিত হয়।
জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পটভূমি
বিশ্ব নেতৃবৃন্দের পাশাপাশি তিনটি বেসরকারি সংস্থা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নান উদ্যোগ গ্রহণ করে। Commission to Study the Organization of Peace, Universities committee on the post-war International problem এবং The Union of the Layers in Europe নামক তিনটি কমিটি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বব্যাপী জনমত সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল। এ সংস্থা ও কমিটিগুলো বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলা ছাড়াও জনকল্যাণ ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা প্রতিপন্ন করে। এ সম্পর্কে বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে দিক নির্দেশনা দেয়। বেসরকার এসব সংস্থা ছাড়াও জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কিছু আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এ পদক্ষেপগুলো হলো-
লন্ডন ঘোষণা
১৯৪১ সালের ১২ জুন লন্ডনে নয়টি প্রবাসী সরকার, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ইউনিয়ন অব সাউথ আফ্রিকা এবং গ্রেট ব্রিটেন সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ বন্ধ এবং যুদ্ধোত্তর বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে ঘোষণা দেন, তাই লন্ডন ঘোষণা নামে পরিচিত। এটি জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার প্রথম পদক্ষেপ।
আটলান্টিক চার্টার
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ১৯৪১ সালের ২৪ আগস্ট আটলান্টিক মহাসাগরে ব্রিটিশ রণতরী ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’- এ এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠক শেষে দুই নেতা যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা দেন, তাকে ‘আটলান্টিক চার্টার’ নামে অভিহিত করা হয়। এটি জাতিসংঘ গঠনের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
আরও পড়ুন: ফ্যাসিবাদ বলতে কি বুঝ? ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্যগুলো কি কি?
ওয়াশিংটন ঘোষণা
১৯৪২ সালের ১ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল, সোভিয়েত প্রতিনিধি লিটভিনভ এবং চীনের প্রতিনিধি টি.ভি.শুঙ ওয়াশিংটনে এক বৈঠকে মিলত হন এবং একটি দলিলে স্বাক্ষর করেন। ২ জানুয়ারি ১৯৪২ মিত্রপক্ষের আরো ২২ টি দেশ এ দলিলে স্বাক্ষর করে।
ভার্জিনিয়া সম্মেলন
১৯৪৩ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া শহরে অনুষ্ঠিত ৪১ টি দেশের প্রতিনিধিদের সম্মেলন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল। এ সম্মেলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা প্রতিষ্ঠিত (FAO) হয়।
মস্কো সম্মেলন
১৯৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের পররাষ্ট্র মন্ত্রীগণ এবং মস্কো নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত মস্কো শহরে মিলিত হয়ে ৭ দফা চুক্তি প্রণয়ন করে। এ চুক্তির ৪ ও ৭ নং দফায় জাতিসংঘ নামটি ব্যবহার করা হয়।
তেহরান সম্মেলন
তেহরান সম্মেলন যুদ্ধকালীন মিত্রশক্তির প্রথম শীর্ষ সম্মেলন। ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে তেহরানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট স্টালিন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল মিলিত হন। এ সম্মেলনে তিন নেতা একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, যা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ব্রিটন উডস সম্মেলন
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারের ব্রিটন উডস শহরে ৪৪ টি রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দের সম্মেলন জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল।
ডাম্বারটন ওকস সম্মেলন
১৯৪৪ সালের ২১ আগস্ট থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডাম্বারটন ওকস ভবনে জাতিসংঘ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে জাতিসংঘ এবং এর চারটি অঙ্গসংগঠন গড়ে তোলার প্রস্তাব করা হয়। ডাম্বারটন ওকস সম্মেলনে প্রণীত খসড়ার মাধ্যমে জাতিসংঘ সনদের সম্ভাব্য রূপরেখা রচিত হয়।
United Nations: A History
ইয়াল্টা সম্মেলন
বর্তমান ইউক্রেনের ইয়াল্টায় ১৯৪৫ সালের ৪-১১ ফেব্রুয়ারি মিত্রপক্ষের শীর্ষ তিন নেতা দ্বিতীয় শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হন। এ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ও চীনকে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এবং ৫ টি স্থায়ী সদস্যকে ‘ভেটো ক্ষমতা’ প্রদান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ফ্রান্সিসকো সম্মেলন
১৯৪৫ সালের ২৫ এপ্রিল – ২৬ জুন সানফ্রান্সিসকোতে মিত্রশক্তির দেশসমূহ বৈঠকে মিলিত হয়। ৫০ টি দেশের ৮৫০ জন প্রতিনিধি এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে। ১০ টি পূর্ণাঙ্গসভা এবং ১২ টি কমিটির মাধ্যমে ‘ডাম্বারটন ওকস পরিকল্পনা’ ও ইয়াল্টা সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবসমূহ আলোচনা করা হয়। অনেক আলোচনা, পর্যালোচনা শেষে জাতিসংঘ সনদ গৃহীত হয়। ১১১ টি ধারা এবং ১৯ টি অধ্যায়ের সমন্বয়ে জাতিসংঘ সনদ তৈরি করা হয়। ২৬ জুন ১৯৪৫ সালে উপস্থিত ৫০ টি দেশ ও জাতির সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের জন্ম হয়। ১৫ অক্টোবর পোল্যান্ড সনদে স্বাক্ষর করে এবং ২৪ অক্টোবর ১৯৪৫ জাতিসংঘ আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে।