বহুজাতিক সংস্থা পুঁজিবাদ বিকাশের একটি অন্যতম হাতিয়ার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বে প্রভাব বিস্তারের মানসিকতা পোষণ করে। এ জন্য তারা পুঁজিবাদের বিকাশ সাধনে ব্রতী হয়ে ওঠে। পুঁজিবাদ বিকাশে বৈদেশিক সাহায্যের নামে কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। এই শর্ত এবং সাহায্যের মাধ্যম হল বহুজাতিক সংস্থা।বহুজাতিক সংস্থাগুলোই পুঁজিবাদের বিস্তার ঘটিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রের অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বহুজাতিক সংস্থা কি?
সাধারণ অর্থে আন্তর্জাতিক একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানসমূহকে বহুজাতিক সংস্থা বলে। আর একটু গুছিয়ে বললে বলা যায়, বহুজাতিক সংস্থা হলো এমন একটি সংস্থা যা বিভিন্ন দেশে পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা উৎপাদন পরিচালনা করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্যামসাং, বাটা, সনি প্রভৃতি সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন এর মাধ্যমে ব্যবসায়িক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ঔষধ (বায়ার, হোয়েকস্ট), টিভি-রেডিও (ফিলিপস), জুতা (বাটা), পানীয় (কোকাকোলা) প্রভৃতি দ্রব্য উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার তৎপরতা রয়েছে।
বহুজাতিক সংস্থার সংজ্ঞা
সাধারণত ছয় বা তার বেশি রাষ্ট্রে বিনিয়োগকারী সংস্থা হচ্ছে বহুজাতিক সংস্থা। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা ৬৫০ টি বৃহৎ আন্তর্জাতিক সংস্থাজে বহুজাতিক নামে সংজ্ঞায়িত করেন।
১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের “M.N.C In World Development” নামক গ্রন্থে বলা হয়, “বহুজাতিক সংস্থা হল এমন এক ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যার মূল কার্যক্রম হচ্ছে পণ্য প্রস্তুত ও সেবা উৎপাদন এবং অন্তত দুটো দেশ জুড়ে যার কার্যক্রম বিস্তৃত।
John H. Durning এর মতে, “বহুজাতিক সংস্থা হলো এমন একটি অর্থনতিক উদ্যোগ যারা একাধিক দেশে উৎপাদন ক্ষেত্রে (কারখানা, খনি, তৈল শোধনাগার, বিতরণ প্রভৃতি) হয় মালিক নয়ত নিয়ন্ত্রণকারী।”
উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বহুজাতিক কোম্পানি হচ্ছে সে সব সংস্থা যাদের একাধিক দেশে বাণিজ্য সম্পর্ক আছে এবং যাদের মূল কার্যক্রম হল পণ্য উৎপাদন ও সেবা প্রদান, যারা সে দেশের কর ও শিল্প আইন মেনে চলে এবং উন্নত দেশে বা কেন্দ্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।
আরও পড়ুন: অসহযোগ আন্দোলন কী? অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি ও কারণসমূহ
তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিতে বহুজাতিক সংস্থার প্রভাব
অর্থনীতি হলো একটি রাষ্ট্রের উন্নতি ও অবনতির মাপকাঠি। প্রত্যেক রাষ্ট্রেই একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিদ্যমান, যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের অর্থ সংক্রান্ত বিষয়গুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তাই একটি সুস্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই পারে দেশকে প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এবং সেই সাথে দেশীয় প্রবৃদ্ধিকেও হরণ করে। নিম্নে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনীতিতে বহুজাতিক সংস্থা কিভাবে প্রভাব ফেলে তা আলোচনা করা হল-
১) পুঁজি বিনিয়োগ
পুঁজিবাদের বিকাশ সাধনই বহুজাতিক সংস্থার মূল উদ্দেশ্য। তাই তারা অনুন্নত রাষ্ট্রগুলোকে সাহায্যের লোভ দেখিয়ে পুঁজির বুনিয়াদ গড়ে তুলে। ব্রিটিশ ওবার সিজ এইডের এক রিপোর্টে (১৯৮৪) দেখা যায়, ব্রিটিশ করদাতারা বহুমুখী সাহায্য সংস্থাগুলোকে সাহায্য দিয়েছে ৫০ কোটি পাউন্ড। আর এসব সংস্থা ব্রিটিশ কোম্পানিগুলোকে পণ্য ক্রয়ের অর্ডার দিয়েছে ৬০ কোটি পাউন্ড।
ম্যাগডফ দেখান যে, ১৯৫০-৬৫ সালের মধ্যে এই সংস্থাগুলো যে পরিমাণ বিনিয়োগ করে তার তিনগুণ অর্থ তারা ফেরত নিয়ে যেতে সমর্থ হয়।
২) অর্থনৈতিক সম্পদ অর্জন/অর্থ উপার্জন
পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে। তারা ক্রমাগত হারে তৃতীয় বিম্বের অর্থনৈতিক সম্পদ কুক্ষিগত করে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিপুল পরিমাণ অর্থ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো থেকে নিয়ে যাওয়ার ফলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে আরও দূর্বল হয়ে পড়ে।
৩) ব্যবসার প্রসার
তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পুঁজির অভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সুযোগে বহুজাতিক সংস্থাগুলো ক্রমাগত হারে পুঁজি বিনিয়োগ করে থাকে। ফলে এই সংস্থাগুলোর ব্যবসার ব্যাপক প্রসার ঘটে। U.N.O এর সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৩৮ সালে বিশ্বের বৃহৎ নয়টি কোম্পানী ৪০ টি দেশে অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল। ১৯৬৭ সাল নাগাদ তা ৯৬ টি দেশে বিস্তৃত হয়েছে।
৪) পণ্য ও বাণিজ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ
১৯৯৪ সালে বিশ্বব্যাংক “World Development Report” এ উল্লেখ করে যে, খাদ্য, পানীয়, কৃষি কাঁচামাল, খনিজ দ্রব্য ইত্যাদি রপ্তানিতে ৮০-৯০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ৩ থেকে ৬ টি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা। বিশ্বের মোট উৎপাদিত কম্পিউটারের ৭০ ভাগ নিয়ন্ত্রণ কের ১০টি সংস্থা।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর বাণিজ্যিক তৎপরতায় উন্নয়নশীল দেশগুলো প্রতি বছর ৭০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের রপ্তানি আয় হতে বঞ্চিত হয়।
৫) বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ
বহুজাতিক সংস্থার কেন্দ্রীয় পর্যায় হতে স্থানীয় কোম্পানীকে ভর্তুকি প্রদান করা হয়। এবং পণ্যের দাম হ্রাস করে পূর্ণপ্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে হটিয়ে বাজার ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ নেয়। এতে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো শোষণের কবলে পড়ে।
৬) রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ
বহুজাতিক সংস্থাগুলো কেবল পণ্য উৎপাদন করেই ক্ষান্ত থাকে না। এদের কেন্দ্রীয় পর্যায় হতে পণ্য রপ্তানির নীতিমালাও নির্ধারিত থাকে। ফলে তৃতীয়ে বিশ্বের দেশগুলো রপ্তানি নীতিরও ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ করে থাকে কোম্পানীগুলো।
এভাবে বিভিন্ন উপায়ে বহুজাতিক সংস্থাগুলো অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতিতে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতিতে বহুজাতিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণ
বহুজাতিক সংস্থার মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, যা ঔপনিবেশিক শাসনের অনন্য রূপ।
নিম্নে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি আলোচনা করা হল-
১) সরকার ব্যবস্থায় প্রভাব
খাদ্য, পানীয়, তেল-গ্যাস উত্তোলন প্রভৃতি খাতে কতিপয় বহুজাতিক সংস্থার ব্যাপক আধিপত্য। এই আধিপত্য দেশের দ্রব্য মূল, মুদ্রাস্ফীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি-পৃকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে, যা খুব সহজেই একটি সরকারের উত্থান-পতনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারে।
২) তেল নিয়ন্ত্রণ
তেল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতি ব্যবস্থার অন্যতম নিয়ামক। তেল-গ্যাসের ইতিহাসে Seven Sisters খ্যাত সাতটি কোম্পানি নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এই কোম্পানিগুলো নিজেদের কর্তৃত্ব আরো শক্তিশালী করতে একত্রিত হয়ে চারটি প্রধান কোম্পানির সৃষ্টি করে। এগুলো হল- শেল, এক্সন সবিল, শেভরন, বিপি।
৩) তেল জাতীয়করণ প্রতিহত
১৯৫০ সালে ইরানের প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেক তেল জাতীয়করণে সর্বাগ্রে এগিয়ে আসেন। এতে ১৯১৩ সাল হতে British Petroleum (BP) এর একচেটিয়া বাণিজ্যের অধিকার খর্ব হয়। এ সময় ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থার অনুরোধে যুক্তরাষ্ট্রের Central Intelligence Agency (CIA) মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে ‘অপারেশন এজাক্স’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। পরিণতিতে মোসাদ্দেক ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং তেল জাতীয়করণ নীতি বিলুপ্ত হয়।
৪) চুক্তির মাধ্যমে সার্বভৌমত্ব খর্ব
গ্যাস দাহন অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ক্ষতির কারণ। অথচ নাইজেরিয়ার শেল কোম্পানি আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গ্যাস পুড়িয়ে যাচ্ছে। কারণ এই কোম্পানি উগান্ডার সাথে “Production Sharing Agreement (PSA) নামে একটি চুক্তি করে যেখানে উল্লেখ্য যে, উগান্ডা সরকার গ্যাস দাহন সংক্রান্ত কোন আইন প্রণয়ন করলে কোম্পানিকে তার উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে যা রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নগত সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ করে।
পরিশেষে বলা যায়, বহুজাতিক সংস্থা তৃতীয় বিশ্বের পুঁজিবাদ বিকাশের এক অভিনব কূট-কৌশল। যার মাধ্যমে উন্নত বিশ্ব উন্নয়নশীল বা অনুন্নত বিশ্বে রাজনৈতিক শাসন ও অর্থনৈতিক শোষণ কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। তাই এটি পরোক্ষভাবে ঔপনিবেশিকতার অনন্য রূপ।