সরকারি ব্যবস্থাপনায় Performance Indicator বা কার্যসম্পাদন নির্দেশক এর প্রচলন উন্নয়নশীল দেশসমূহে অতি সাম্প্রতিক সময়ে শুরু হয়েছে। এর প্রচলন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহে অতিদ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া বিশ্বে ব্যবস্থাপকীয় কার্যাবলি অনুশীলন ও সম্পন্ন করার ক্ষেত্রে কার্যসম্পাদন মূল্যায়ণ (Performance Measurement) ধারণার প্রয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন- সিঙ্গাপুরে প্রায়িই সম্ভাব্য বিনিয়োগ ও প্রতিকূলতা যাচাই করা হয়। আর কার্যসম্পাদন মূল্যায়ণের ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশক ও নীতি রয়েছে যার মাধ্যমে কার্য মূল্যায়ণকে যুক্তিসিদ্ধ করা হয়।
কার্যসম্পাদন নির্দেশক (Performance Indicator)
কোনো কার্যসম্পাদন এর বাস্তবভিত্তিক পরিমাপ মূলত ৪ টি উপাদানের উপর নির্ভর করে। এগুলোকেই কার্যসম্পাদন নির্দেশক বলা হয়। যথা-
- Input
- Output
- Outcome
- Process
নিম্নে কার্যসম্পাদন নির্দেশক সমূহ আলোচনা করা হল-
- Input
এটা হলো কোনো কার্যসম্পাদনের সূচনা। এখানে প্রাপ্ত সম্পদ বিনিয়োগের মাধ্যমে সেবা উৎপাদন করার ব্যবস্থা করা হয়। আর ভাল সেবা উৎপাদনের জন্য প্রয়োজন সময় মত ভালো মানের ইনপুট। ইনপুট এর সামাজিক মূল্য তার প্রত্যক্ষ খরচের মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়।
যেমন- পুলিশের জন্য ইনপুট হল জন শক্তি বাড়ানো, গাড়ি, রাইফেল ইত্যাদি সরঞ্জাম প্রদান করা।
2. Output
কোন সেবার ক্ষেত্রে ইনপুট প্রদানের ফলে সরাসরি দৃশ্যমান বা বাস্তবভিত্তিক যে ফল পাওয়া যা তা হল আউটপুট। তাই আউটপুট এর সামাজিক মূল্য ও উৎপাদিত সেবার অনুপাতে প্রায় যথাযথ ভাবে সাথে সাথেই পাওয়া যায়।
যেমন- পুলিশের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ইনপুট করলে আসামী গ্রেফতারের সংখ্যাও বেড়ে যায়।
3. Outcome
প্রদত্ত ইনপুট এর ফলে সর্বশেষ প্রাপ্ত সেবা হল আউটকাম। জনগণের রানৈতিক সচেতনতা ছাড়া আউটকাম এর সামাজিক মূল্য নির্ধারণ অত্যন্ত কঠিন।
উদাহরণ- অপরাধী গ্রেফতার এর সংখ্যা বেড়ে গেলে সমাজে অপরাধ কমে যাবে।
4. Process
প্রসেস হল সেই সামাজিক প্রথা যার মাধ্যমে ইনপুট থেকে আউটপুট উৎপন্ন হয় এবং আউটকাম অর্জিত হয়। প্রসেস হল অবিরাম চালিত একটি বিষয়।
উদাহরণ- পুলিশ এর ক্ষেত্রে ইনপুট প্রদান করা হলে আউটপুট ও আউটকাম অর্জিত হবে। ফলে অবিরাম প্রক্রিয়া হিসেবে সমাজে “আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল” বৃদ্ধি পাবে।
আরও পড়ুন: মানব সম্পদ পরিকল্পনা কি? মানব সম্পদ পরিকল্পনার গুরুত্ব বা প্রয়োজনীয়তা কি কি?
কার্যসম্পাদন সংস্কার (Performance Reforms) এর নীতিসমূহ
কার্যসম্পাদন সংস্কার এর ১০ টি নীতি আছে। নিম্নে এগুলো আলোচনা করা হলো-
- The Patton Premise
১৯৪২ সালে জার্মানদের সাথে যুদ্ধে ইউএস বাহিনী চরম বিপর্যয়ের পর কমান্ডিং জেনারেল George Patton যখন সেনা ছাউনি পরিদর্শনে গেলেন তখন হঠাৎ ঘুমন্ত সৈন্যের সাথে হোচট খেলেন। সৈন্যটি বিরক্ত হলেন এবং বললেন- “এই আমি ঘুমানোর চেষ্টা করছি।” কিন্তু Patton এর পরিচয় জানতে পেরে পরক্ষণেই সৈন্যটি এজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে Patton বললেন, ভয় নেই বৎস, এই সেনা দলে একমাত্র তুমিই এমন ব্যক্তি যে কিনা তার যে কর্তব্য সেটি সম্পাদনের চেষ্টা করছে এবং সে সম্পর্কে অবগত। অর্থাৎ, তিনি এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে, পরাজয়ের পরও বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থায়ও সৈন্যটি আদেশ অনুসারে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।
তেমনিভাবে সংগঠনে শক্তিশালী কার্যসম্পাদনের জন্য যে বিষয়ে কাজ করা হবে সে সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত হতে হবে। তবুও দেখা যায় যে, বিভিন্ন দেশে লক্ষ্য নির্ধারণ ছাড়াই কার্যসম্পাদন নির্দেশকগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়।
2. The Accountability Trade off
পরিসংখ্যানগত অনুমানে নির্ভুলতা এবং সম্ভাব্যতার মাঝে বিপরীতমুখী সম্পর্ক বিদ্যমান। তাই কার্যসম্পাদন সংস্কার এর ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা থাকলে Free Lunch এর সম্ভাবনা থাকে না। তাই এদিকটির প্রতি অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।
3. The Step Sister’s Predicament
এই বিষয়টি এসেছে Cinderella গল্প থেকে। অর্থাৎ রাজপ্রাসাদে ফেলে আসা সিনড্রেলার কাঁচের জুতা পরীক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক সিনড্রেলার বাড়ী আসলে তার ২ বোন কৌশলে উক্ত জুতা নষ্ট করে ফেলে। ঐ সময় যদি সিনড্রেলার নিকট বিকল্প জুতা না থাকতো তবে তার পক্ষে রাজবধু হওয়া সম্ভব ছিল না।
এমনিভাবে কার্যসম্পাদন সংস্কার এর ক্ষেত্রেও বিকল্প থাকতে হবে। তবে এর ফলে যে নতুন ধারার সৃষ্টি হবে যা স্থানীয় সংস্কৃতি, সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের সাথে সামঞ্জস্য হবে না।
4. The Missouri Test
যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের অটোমোবাইল এর লাইসেন্স এ লেখা রয়েছে “Show me.” অর্থাৎ, এটি সর্বদা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রস্তুত। তেমনিভাবে কার্যসম্পাদন ভিত্তিক পদ্ধতি এর ক্ষেত্রেও চিরন্তন সত্য যে, তা সব সময় বাস্তব পরীক্ষা এর জন্য প্রস্তুত রাখতে হয়।
5. The Gym Prescription
মৌলিক অর্থনীতিতে ‘উৎপাদন সম্ভাবনা’ ধারণা প্রাপ্ত সম্পদের মাধ্যমে প্রকৃত উৎপাদন সর্বোচ্চ করা ও কারিগরি সীমাবদ্ধতার মাঝে পার্থক্য সৃষ্টি করে। তাই যখন সঠিক সময়ে সঠিকভাবে কার্যসম্পাদন নির্দেশক পছন্দ করা হবে তখন একটা নির্দিষ্ট লেভেল পর্যন্ত লক্ষ্য স্থাপন করতে হবে যাতে করে উক্ত লক্ষ্য অর্জন করা যায়।
6. The Titanic Warning
১৯১২ সালে বিলাস বহুল জাহাজ Titanic উত্তর আটলান্টিক মহাসাগরে বরফ খন্ডের সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়। এখানে দুটো শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যথা-
১) এটা কখনো মনে করা যাবে না যে, কোন নির্দিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার Unsinkable হবে না এবং সাফল্যকে বাধাগ্রস্ত করবে না।
২) টাইটানিক জাহাজ অদৃশ্যমান বরফ খন্ডর সাথে ধাক্কা লেগে ডুবে যায়।
অর্থাৎ কর্মসম্পাদন সংস্কার এর ক্ষেত্রে অদৃশ্য বিষয় বা অদৃশ্য হুমকিসমূহ বিবেচনায় আনতে হবে।
7. The Heisenberg Dilemma
এটি পদার্থ বিদ্যার বিখ্যাত Heisenberg অনিশ্চয়তা থেকে এসেছে। কার্যসম্পাদন সংস্কার এর ক্ষেত্রে এটা মনে করা যাবে না যে, গৃহীত পদক্ষেপ অত্যন্ত কার্যকর হবে। তাছাড়া নতুন উপায় মানুষের আচরণেও পরিবর্তন আনে।
অতএব এটি সরকারি কর্মচারীদের আচরণেও গুরত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে।
8. The Turkish Evasion
এটার মূল কথা হচ্ছে, যদি এটা করা মূল্যবান না হয়, তবে এটা করা মূল্যবান নয়।
9. The Dreedle Illusion
Joseph Heller এর যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস Catch-22 এ commanding air general Dreedle তার এক সৈন্যকে বেশি করে প্রশংসা করলেন, যে কিনা আদেশ অনুসারে খালি মাঠে বোমার দ্বারা গর্ত সৃষ্টি করেছিল।
আবার তিনি অন্য সৈন্যকে ভর্ৎসনা করলেন, যে কিনা তার টার্গেট ঠিকমত ভেদ করতে পারেনি। অর্থাৎ এলোমেলো ভাবে বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে লক্ষ্যভেদ করেছিল।
অর্থাৎ,পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি কর্মক্ষেত্র কার্যসম্পাদন সংস্কার এর ক্ষেত্রে যথাসম্ভব পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে।
10. The Mechanic’s Principle
যদি সরকারি ব্যবস্থাপনাগত কার্যাবলি মেনে নেয়ার মত ভাল হয়, তাহলে সে ক্ষেত্রে সংস্কারের প্রতি অতি মনোযোগ না দেওয়াই ভাল। কেননা এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আবার এর দ্বারা এটাও বুঝায় না যে, মাঝারি মানের কার্যসম্পাদন মেনে নিতে হবে। তবে যদি অনিয়ম ও দূর্নীতি দেখা দেয় তাহলে সে ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারই হল উন্নতির একমাত্র উপায়।