দলীয়করণের ফলাফল
দলীয়করণ এর ফলাফল দুইভাবে হয়ে থাকে।
১) দলীয়করণের সুবিধা ও
২) দলীয়করণের অসুবিধা
দলীয়করণের সুবিধা
১) প্রশাসনে দলীয়করণের ফলে (প্রশাসন ও রাজনৈতিক কর্মকর্তা) এক ও অভিন্ন চিন্তাধারার বিশ্বাসী হয় বলে দেশের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা প্রণয়নে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় না।
২) দলীয়করণের ফলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা উচ্চপদে আসীন হওয়ার আশায় দলের প্রতি অনুগত থাকে। ফলশ্রুতিতে, কোন প্রকারের বিরোধীতা না থাকায় প্রশাসনের গতিশীলতা বৃদ্ধি পায়।
দলীয়করণের অসুবিধা
১) প্রশাসন মেধাশূণ্য হয়ে পড়ে
প্রশাসনিক দলীয়করণের ফলে প্রশাসনে সরকারি দলের কর্মীদের প্রাধান্যতা দেখা দেয়। দলের প্রতি আনুগত্যের পুরস্কার স্বরুপ তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়। ফলে অনেক অযোগ্য প্রার্থী প্রশাসনে অধিষ্ঠিত হয়। এই নিয়োগের ফলে অনেক যোগ্য ও মেধাবী প্রার্থী নিয়োগে বঞ্চিত হয়। ফলে প্রশাসন হয়ে পড়ে মেধাশূণ্য, যা প্রশাসনে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেয় এবং প্রশাসনিক সেবার মান হ্রাস ঘটায়।
২) নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সমস্যা
একটি দেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ নীতিসমূহ প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিষয় ভিত্তিক দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন আমলাদের পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন হয়। প্রশাসনিক দলীয়করণের ফলে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে অবস্থান করে অযোগ্য ও অদক্ষ লোকজন। বাস্তবিক জ্ঞানের অভাবে এ সকল কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রণীত নীতিসমূহ হয় অকার্যকর ও দূর্বল। এমতাবস্থায় নীতির বাস্তবায়নও অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাছাড়া এই নীতিগুলো দেশের স্বার্থে না হয়ে তাদের হীন স্বার্থের বদৌলত হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী কি? চাপ সৃষ্টিকারী গোষ্ঠীর ভূমিকা কি?
৩) নিরাপত্তার সমস্যা
প্রশাসনিক দলীয়করণের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়। কারণ সর্বত্র অনিয়ম ও ব্যর্থতা, অস্থির পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে অনিয়ন্ত্রিত অবস্থার সৃষ্টি হয়।
৪) রাজনৈতিক অস্থিরতা
প্রশাসনিক দলীয়করণের ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমভাবে প্রকাশ পায়। সর্বত্র দলগত কার্যাবলী প্রদর্শিত হওয়ার ফলশ্রতিতে রাজনৈতিক দলগুলোর অন্তঃদ্বন্ধ ও কোন্দল প্রশাসন থেকে রাষ্ট্রের সর্বত্র বিরাজিত হয়। এর ফলে একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
৫) সম্পদের অসম বণ্টন
দলীয়করণ যখন স্পষ্টরূপে প্রকাশ পায়, তখন অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ অর্থের জোরে ফায়দা হাসিলের মাধ্যমে প্রশাসনের অর্থবহ পদসমূহ দখল করায় প্রশাসনে সেবা পূর্ণতা পাবার বদলে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়।
৬) শিক্ষা ব্যবস্থার অবনতি
বর্তমানে আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠন সমূহের প্রশাসনিক কার্যক্রমসমূহ সহ শিক্ষাব্যবস্থাতেও দলীয়করণের মারাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মেধার অবমূল্যায়নের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে অদক্ষ কর্মকর্তা এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে অযোগ্য শিক্ষকও নিয়োগ করা হয়। পরিণতিতে ছাত্ররা একটি চাকুরির নিশ্চয়তার জন্য পড়াশোনা বাদ দিয়ে রাজনীততিতে প্রবেশ করছে।
৭) যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি অবহেলা
দলীয়করণের ফলে যোগ্য প্রার্থীদের প্রতি অবহেলা করা হয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে। যেমন-
ক) নিয়োগ: বর্তমানে যেকোন সরকারি চাকরি নিয়োগ ব্যবস্থায় দলীয়করণ একটি নীতিতে পরিণত হয়েছে। দলীয় লোকজন বা দলীয় উচ্চপদস্থ লোকের সুপারিশ ছাড়া কোনো একটা চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রশ্নফাঁসের মতন ন্যাক্কারজনক ঘটনা। ফলে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা অবহেলিত হচ্ছে।
খ) পদোন্নতি: দলীয়করণের অন্যতম আরেকটি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে পদোন্নতি। এখন মেধা ও জৈষ্ঠ্যতাকে পাশ কাটিয়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিচয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়। অথবা, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের সুপারিশ লাগে।
গ) বদলী: বদলীর মাধ্যমেও দলীয়করণ প্রসারিত হয়েছে। রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশায় প্রশাসন থেকে বিরোধীদলীয় প্রার্থী যতই সৎ ও যোগ্য প্রার্থী হোক না কেন তাদের দুর্গম এলাকায় বদলী করে অত্যন্ত সুবিধাজনক স্থানে দলীয় লোকদের স্থলাভিষিক্ত করা হয়।
৮) নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার
শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সরকার যতদূর করা সম্ভব তার সবটুকুই করে। এর কৌশল হিসেবে ক্ষমতা ছাড়ার প্রাক্কালে নির্বাচন কমিশনে নিজ দলীয় লোক নিয়োগ এমনকি পুলিশের উচ্চপদগুলোতে রদবদল করা হয়।
৯) প্রশাসনিক জবাবদিহিতা
প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের আমলারা তাদের সকল কাজের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য। কিন্তু প্রশাসনে দলীয়করণের ফলে আমলাদের সাথে মন্ত্রীদের গোপন সম্পর্ক বিরাজ করে। ফলে প্রশাসকরা যেকোন দুর্নীতির কাজ অবলীলায় করে থাকে যার ফলে আমলা ও মন্ত্রী উভয়েই উপকৃত হয়।
১০) দুর্নীতি বৃদ্ধি
উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা যদি দলীয়করণের মাধ্যমে নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়ে থাকেন, তবে তাদের কর্মকান্ডও হয় অস্বচ্ছ, অসৎ ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। ফলে এর ধারাবাহিকতা বিরাজ করে সরকারের নিম্ন পর্যায়েও। আর এর ফলশ্রুতিতে প্রশাসনে ক্রমাগত দুর্নীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
১১) জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত
একটি দেশের প্রশাসন যন্ত্র পরিচালিত হয় আমলাতান্ত্রিক দক্ষতার উপর ভিত্তি কর। দলীয়করণ প্রশসানিক কর্মকান্ডকে দারুণভাবে ব্যাহত করে ও বিশৃঙ্খল প্রশাসনিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফলে রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়।
১২) প্রশাসনিক কাঠামো বিনষ্ট
যে কোন দেশের উন্নয়নের জন্য সুশৃঙ্খল প্রশাসনিক কাঠামো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রশাসনিক দলীয়করণের মাধ্যমে আমলাতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি উপেক্ষিত হয় এবং প্রশাসনিক কাঠামো বিনষ্ট হয়ে যায়।
বাংলাদেশে দলীয়করণ বেশী হবার কারণ
বাংলাদেশে দলীয়করণ পরিলক্ষিত হবার কারণগুলো হল-
১) দলের প্রতি আনুগত্য
২) প্রশাসনকে দলের স্বার্থে ব্যবহার করা
৩) সরকারি ক্ষমতায় টিকে থাকা
৪) পুনরায় ক্ষমতা লাভের লোভ
৫) স্বচ্ছ রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব
৬) প্রশাসনে ভিন্ন মতাবলম্বীদের ছাঁটাই
৭) দলীয় লোকদের বিরোধীতা না করা ইত্যাদি।