3.8K
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা শব্দটি বাংলাদেশের আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই। তবে সরকারী কর্তৃপক্ষের ক্রিয়াকলাপ পর্যালোচনা করার জন্য সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদে হাইকোর্ট বা নিম্ন আদালতে কার্যক্রম স্থগিত করার জন্য রিট আবেদন করার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনাকে ইংরেজীতে বলা হয় জুডিশিয়াল রিভিউ। নিম্নে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা তথা জুডিশিয়াল রিভিউ সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা কি
বাংলাদেশে সাংবিধানিক প্রাধন্য স্বীকৃত। সুপ্রীম কোর্ট সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে এই প্রাধন্য নিশ্চিত ও সংরক্ষণ করে থাকে। সাংবিধানিক এই ক্ষমতাবলে সুপ্রীম কোর্ট আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কার্যাবলী পর্যালোচনা করতে পারেন এবং সংবিধান বা অন্য কোন প্রচলিত আইনের পরিপন্থী যেকোন আইন বাতিল বা রদ ঘোষণা করতে পারেন।
প্রশাসনিক কার্যক্রমের উপর বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ বলতে এমন এক পদ্ধতি বুঝায় যার মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্ট প্রশাসনের বা নির্বাহী বিভাগের গৃহীত কার্যক্রমের সাংবিধানিক বৈধতা নির্ধারণ করে থাকেন। সুপ্রীম কোর্ট তার তত্ত্বাবধায়নের এখতিয়ার প্রয়োগ করে প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। আইনের শাসন এবং সাংবিধানিক প্রাধন্য নিশ্চিত করতে প্রকৃতপক্ষে এরূপ বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন। প্রত্যেক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা হয়।
দেওয়ানী কার্যবিধির ৯ ধারার মতে, আইনে নিষিদ্ধ না হলে দেওয়ানী প্রকৃতির সকল প্রকারের মামলার বিচার দেওয়ানী আদালতগুলো করতে পারবে এবং সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইনের বিধান অনুযায়ী প্রতিকার দিবে। এই ক্ষমতাবলে আদালত প্রশাসনিক সকল কার্যক্রমই পর্যালোচনা করতে পারে।
উচ্চ আদালতের বিচার বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত। সংবিধানের ১০২ ও ৭ অনুচ্ছেদের এটাই হচ্ছে মর্মকথা। সংবিধানের মূল বৈশিষ্ট্যে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, উচ্চ আদালতের এরূপ কর্তৃত্ব সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমেও সংকুচিত বা বাতিল করা যাবে না।
বিচারিক পর্যালোচনা (Judicial Review) ক্ষমতাবলে সুপ্রীম কোর্ট শুধুমাত্র প্রশাসনিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে না, সংবিধানের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন করে এরূপ আইন প্রণয়নও বাতিল ও অকার্যকর ঘোষণা করতে পারে। বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে যে কোন কার্যক্রমের বৈধতা ও সাংবিধানিকতা নির্ধারণ করা হয়।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা এর ভিত্তি দু’টি। যথাঃ
- Ultra vires (ক্ষমতা বহির্ভূত মতবাদ), এবং
- Natural Justice (স্বাভাবিক ন্যায়বিচার নীতি)।
আলট্রা ভাইরেস বা ক্ষমতা বহির্ভূত মতবাদ এবং ন্যাচারাল জাস্টিস বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচার মতবাদটি ব্রিটিশ কমন ল’ উদ্ভূত এবং উত্তরাধিকার সূত্রে এগুলো বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় স্থান করে নিয়েছে।
Ultra vires বা ক্ষমতা বহির্ভূত মতবাদ
সংবিধান হচ্ছে দেশের সর্বোচ্চ আইন এবং সংবিধানের অভিভাবক হচ্ছে সুপ্রীম কোর্ট। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক, বিচারিক, আইন প্রণয়নসহ সকল কার্যক্রম এই সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। কাজেই কোন কার্যক্রম সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই করে দেখার অধিকার সুপ্রীম কোর্টের রয়েছে। জুডিশিয়াল রিভিউ এর আওতায় সুপ্রীম কোর্ট কোন কার্যক্রমের বৈধতা পরীক্ষা করে থাকে। সংবিধিানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে তা আলট্রা ভাইরেস ঘোষণা করে অকার্যকর করতে পারে।
Natural Justice বা স্বাভাবিক ন্যায়বিচার নীতি
ন্যাচারাল জাস্টিসের মূলকথা হচ্ছে সৎ ও নিরপেক্ষ পদ্ধতি অনুসরণ। এর ব্যতিক্রম ঘটলে জুডিশিয়াল রিভিউ এর আওতায় বিবেচনা করে আদালত তা অকার্যকর ঘোষণা করতে পারে। স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি প্রয়োগ করেই সমগ্র বিশ্বে আইন ও সংবিধান সমৃদ্ধশালী করা হয়েছে। স্বেচ্ছাচারিতা রোধে স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের পরিপন্থী হলে তা পদ্ধতিগত আলট্রা ভাইরেস হিসেবে গণ্য করা যায়। এটা দু’শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-
১) কোন ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে শাস্তি দেয়া যায় না।
২) কোন ব্যক্তি নিজ স্বার্থ জড়িত রয়েছে এমন বিচার কার্য সম্পাদন করতে পারে না।
তাই দেখা যায় যে, স্বাভাবিক ন্যায়বিচারের নীতি ও আলট্রা ভাইরেস মতবাদ প্রয়োগের মাধ্যমে দেশের উচ্চ আদালত বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার মাধ্যমে কার্যক্রম গ্রহণ করে প্রত্যেকটি পদক্ষেপের বৈধতা নিরুপণ করে থাকে।
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার সীমাবদ্ধতা
নিম্নোক্ত বিষয়সমূহে বিচারিক পর্যালোচনার সীমাবদ্ধতা দেখা যায়-
১) সংসদে স্পীকার কর্তৃক যদি কোন বিলকে অর্থ বিল হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয় তাহলে সে বিষয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না।
২) তফসিলের আইনের সংশোধনীর এখতিয়ার গণপরিষদের।
৩) সংসদের কার্যধারার বৈধতা সম্পর্কে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বিচার বিভাগ
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার তাৎপর্য
বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার গুরুত্ব নিম্নে উল্লেখ করা হল-
১) বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সংসদ কর্তৃক প্রণীত আইনকে বৈধতা প্রদান করে। দেশের সর্বোচ্চ আইনগত স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রীম কোর্ট জুডিশিয়াল রিভিউ পরিচালনা করে থাকে।
২) বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা সংসদীয় সার্বভৌমত্বকে নিজস্ব সীমাবদ্ধতার থেকে কাজ করতে সাহায্য করে। এটি পার্লামেন্টের ‘সংশোধনী ক্ষমতা’ এবং সাংবিধানিক ক্ষমতার’ মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে।
৩) উপজেলা পরিষদ অধ্যাদেশ বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার প্রয়োগের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনা। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে সরকারকে বিভিন্ন প্রশাসনিক শাখায় বিভক্তকরণের নির্দেশ দেয়া হয় এবং ঐ সকল শাখায় নির্দিষ্ট সময় অন্তর নির্বাচনের ব্যবস্থা করার ঘোষণা করা হয় যা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করে।
৪) বিচার বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলাকে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার অন্যতম উপায় হিসেবে ধরা হয়। আইনের নির্দেশের অবাধ্যতা বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে অসন্তোষ এবং বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা গণতন্ত্রের পথকে রুদ্ধ করে।
বাংলাদেশ সংবিধান ১০২ অনুচ্ছেদ সুপ্রীম কোর্টকে বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনার ক্ষমতা প্রত্যক্ষভাবে দিয়েছে। সংবিধানের ৪৪ ও ১০২(১) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে আদালত কারো মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে তা বলবৎ করতে পারে।