সার্থক ভিক্ষু জীবন গঠনে বুদ্ধের শিক্ষা
শ্রাবস্তীর পূর্বারামে একদিন ব্রাহ্মণ গণক মৌদগল্যায়ন এলেন বুদ্ধের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সন্তোষজনক স্মরণীয় আলাপের পর ব্রাহ্মণ গণক পূর্বারামের সোপান শ্রেণীর উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন–
ভবৎ গৌতম, এ সোপান শ্রেণী যেমন ক্রমান্বয়ে ধাপে ধাপে ঊর্ধ্বদিকে উঠেছে, তেমনি ব্রাহ্মণদের শাস্ত্রাধ্যয়ন আনুপূর্বিকভাবে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হয়, ধনুর্বিদ্যায় ও গণিত শাস্ত্রে শিক্ষাদানও আনুপূর্বিক ধাপে ধাপে চলতে থাকে। তেমিন আপনার প্রবর্তিত ধর্মবিনয়ে আনুপূর্বিক পদ্ধতি দেখাতে পারেন কি?
বুদ্ধ উত্তর করলেন-হ্যাঁ, দেখানো যাবে। যেমন নিপুণ অশ্ব দমনকারী প্রথমে মুখে লাগাম নেওয়া শেখায় এবং পরে অন্যান্য ধারাবাহিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করে, তেমনি তথাগত লোককে দীক্ষা দিয়ে প্রথমেই শীল বা চারিত্রিক শিক্ষায় সংযত আচরণসম্পন্ন ও পাপভীরু করে তুলতে চেষ্টা করেন।
হে ব্রাহ্মণ, যখন ভিক্ষু শীলবান, সংযত আচারসম্পন্ন ও পাপভীরু হয়, তখন তথাগত তাকে ইন্দ্রিয় সংযম শেখান। সেই শিক্ষা অনুসারে ভিক্ষু রূপ দেখে, শব্দ শুনে, গন্ধ আঘ্রাণ করে কিংবা রসাস্বাদন ও স্পর্শানুভূতিতে মত্ত হয় না অথবা এ সব মনে মনে উপভোগ করে না। যে ইন্দ্রিয়গুলো অসংযত থাকলে লোভ, দৌর্মনস্য ও পাপ মনোবৃত্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে অন্তরকে অভিভূত করে, সে ইন্দ্রিয়গুলোকে সংযত করার জন্য তার প্রবৃত্তি হয় এবং এদেরকে সে রক্ষা করে।
আরও পড়ুন: বৌদ্ধ ধর্মমতে যে ৮টি কারণে ভূমিকম্প হয়
হে ব্রাহ্মণ, যখন ভিক্ষু ইন্দ্রিয় সংযম শিক্ষায় সংযতেন্দ্রিয় হয়, তখন তথাগত তাকে শিক্ষা দেন-“এসো ভিক্ষু, ভোজনে মাত্রাজ্ঞ হও, জ্ঞানযুক্ত ও সচেতন হয়ে আহার করো, মনে রেখো তোমার আহার ক্রীড়ার জন্যে নয়, মত্ততার জন্যে নয়, দেহকে শ্রীমণ্ডিত করার জন্যে নয়, শুধু দেহ পালনের জন্যে এবং দেহের স্থিতির জন্যে।”
হে ব্রাহ্মণ, যখন ভিক্ষু ভোজনে মাত্রাজ্ঞ হয়, তখন তথাগত তাকে শিক্ষা দেন-“এসো ভিক্ষু, সদাজাগ্রত হও, সারাদিন পায়চারি করে বা বসে মনের কলুষ বিদূরিত করে মনকে শুদ্ধ ও অনাবিল করো। রাত্রির প্রথম প্রহরে পায়চারি করে ও বসে মনকে কলুষমুক্ত ও শুদ্ধ করো। মধ্যরাত্রে গভীর নিশীথে দক্ষিণ পার্শ্ব ভর করে, পায়ের ওপর পা রেখে সিংহশয্যায় শয়ান হও, স্মৃতিমান হয়ে গাত্রোত্থানের সংকল্প নিয়ে এবং রাত্রির শেষ প্রহরে গাত্রোত্থান করে বসে ও পায়চারি করে মনকে শুদ্ধ অনাবিল করো।”
হে ব্রাহ্মণ, যখন ভিক্ষু এভাবে সদা জাগ্রত হয়, তখন তথাগত তাকে আরও শিক্ষা দেন “এসো ভিক্ষু, স্মৃতিমান সজ্ঞান থেকে অগ্রগতিতে, পশ্চাদগমনে, দর্শনে, শ্রবণে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংকোচনে, প্রসারণে, পাত্রচীবর ধারণে, আহারে, পানে, স্থিতিতে, গমনে, উপবেশনে, শয়নে, বাক্যালাপে, মৌনতায়-এক কথায় সকল অবস্থায় আত্ম-বিস্তৃত না হয়ে প্রতি অবস্থাকে স্মরণে রেখে সজ্ঞান থেকে অবহিত হয়ে বাস করো।”
হে ব্রাহ্মণ, যখন ভিক্ষু সকল অবস্থায় স্মৃতিমান সজ্ঞান হয়ে থাকতে পারে, তখন তথাগত তাকে আরো শিক্ষা দেন “এসো ভিক্ষু, নির্জনবাসে রত হও–অরণ্যে, বৃক্ষমূলে, পর্বতকন্দরে, গিরিগুহায়, জনহীন প্রান্তরে গহনবনে সাধনামগ্ন হও।” সে এতাদৃশ নির্জনস্থানে আহারের পর শরীর ঋজু রেখে আসনবদ্ধ হয়ে সাধনারত হয়। সে লোভ বিনোদন করে বীতলোভ চিত্ত নিয়ে থাকে, লোভ থেকে চিত্তকে শুদ্ধ রাখে। দ্বেষ ত্যাগ করে বিদ্বেষহীন মন নিয়ে সর্বপ্রাণীর প্রতি অনুকম্পা পরায়ণ হয়। দ্বেষ থেকে চিত্তকে শুদ্ধ করে আলস্য জড়তা বিনোদন করে নিরলস আলোকসম্পন্ন স্মৃতিমান সম্প্রজ্ঞ হয়ে থাকে। এরপর মনের ঔদ্ধত্য বা উদ্বেগ পরিহার করে অনুদ্ধত, অনুদ্বিগ্ন ও শান্তচিত্ত হয়। তারপর সংশয় বিনোদন করে অসংশয়ী ও নিঃসন্দিগ্ধ হয় এবং সংশয় থেকে চিত্তকে শুদ্ধ করে কুশল ধর্মের প্রতি এগিয়ে যায়। এভাবে সে চিত্তদোষক পঞ্চনীবরণ বা অন্তর প্রতিবন্ধক অতিক্রম করে কামনা ও কুপ্রবৃত্তির কবল থেকে মুক্ত হয়ে ক্রমান্বয়ে ধ্যানের উত্তরোত্তর স্তর লাভ করে।
হে ব্রাহ্মণ, যে ভিক্ষুগণ শিক্ষানিবিষ্ট, শিক্ষানুরাগী, নির্বাণপ্রার্থী ও লক্ষ্যে অনুপনীত, তাদের জন্য আমার এ অনুশাসন। তবে যারা অর্হৎ, ক্ষীণাস্রব, মহালক্ষ্যে উপনীত এবং বন্ধনহীন শুদ্ধমুক্ত-এ ধর্মগুলো তাদের ঐহিক স্বাচ্ছন্দ্য দান করে।
এ ভাষণ শুনে ব্রাহ্মণ গণক মৌদগল্যায়ন বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন-
ভবৎ গৌতম, এভাবে আপনার দ্বারা উপদিষ্ট ও অনুশাসিত হয়ে আপনার শিষ্যেরা সবাই কি নির্বাণ সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন?
উত্তরে বুদ্ধ বললেন-হে ব্রাহ্মণ, আমার শিষ্যেরা এভাবে উপদিষ্ট ও অনুশাসিত হয়ে কেউ নির্বাণ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে, কেউ করে না।
ব্রাহ্মণ–ভবৎ গৌতম, এর কারণ কি? নির্বাণ আছে, নির্বাণের পথ আছে এবং আপনি উপদেষ্টা পথ-প্রদর্শকও সশরীরে বিদ্যমান, তবুও কেন নির্বাণ সাধনায় কারো সিদ্ধি লাভ হয় এবং কারো হয় না?
বুদ্ধ–হে ব্রাহ্মণ, তবে আপনাকে এখানে জিজ্ঞেস করি, আপনার রুচিসম্মত উত্তর দেবেন। আপনি তো রাজগৃহে যাবার পথ ভালভাবেই জানেন?
ব্রাহ্মণ–হাঁ, ভবৎ গৌতম, রাজগৃহের পথ আমার সুপরিচিত।
বুদ্ধ–ধরুন, রাজগৃহ যাত্রী জনৈক ব্যক্তি আপনাকে রাজগৃহে যাবার পথের নির্দেশ চাওয়ায় আপনি বল্লেন, “ভাই এ রাস্তা ধরে চলতে চলতে একটি গ্রাম পাবে, সেটি ছাড়িয়ে চলতে চলতে একটি নিগম পাবে, সে নিগমের অমুক রাস্তা ধরে চলতে থাকবে। তারপর দূর থেকে দেখতে পাবে রাজগৃহের ধূমায়মান শৈলশ্রেণী। অতঃপর সেই রাস্তা ধরে চলতে চলতে রাজগৃহে গিয়ে পৌছাবে।” আপনার এ নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও সে ব্যক্তি উল্টো পথ ধরে অন্য দিকে চলে গেল। কিন্তু আর এক ব্যক্তি আপনার কাছে রাজগৃহে যাবার পথের যথাযথ নির্দেশ নিয়ে ঠিক পথ ধরে চলতে চলতে নির্বিঘ্নে রাজগৃহে গিয়ে পৌছল।
হে ব্রাহ্মণ, রাজগৃহ আছে, তার পথও আছে এবং আপনিও যথাযথভাবে পথের নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে কেন একজন উল্টো পথ ধরে অন্যত্র চলে গেল?
ব্রাহ্মণ–ভবৎ গৌতম, আমি এখানে কি করতে পারি? আমি তো পথপ্রদর্শক মাত্র।
বুদ্ধ–হে ব্রাহ্মণ, ঠিক তেমনি আমিও কি করতে পারি? আমি পথপ্রদর্শক মাত্র। আমার উপদেশে, আমার অনুশাসনে আমার শিষ্যেরা কেউ নির্বাণ সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে, কেউ করে না।
তখন গণক মৌদগল্যায়ন উচ্ছ্বসিত আবেগে বলে উঠলেন-ভবৎ গৌতম, যে ব্যক্তিরা শুধু জীবিকার জন্যে গৃহত্যাগ করে, আপনার ধর্মানুশাসনে অশ্রদ্ধায় প্রব্রজ্জিত হয়, যারা শঠ-মায়াবী, উদ্ধত-চঞ্চল-চপল, যারা অসংযত বাক, অসংযতেন্দ্রিয় ও অমিতাহারী এবং যারা অজাগ্রত, স্মৃতিহীন, শিক্ষায় অননুরাগী, বিলাসী, অলস, হীনবীর্ঘ, অসমাহিত, বিভ্রান্তচিত্ত ও দুর্বুদ্ধিপরায়ণ, তারা আপনার থেকে বহুদূরে। নির্বাণ দর্শন তাদের পক্ষে সুদূর পরাহত। কিন্তু যাঁরা শ্রদ্ধায় গৃহত্যাগ করে আপনার নিকট দীক্ষিত, যাঁরা সরলপ্রাণ, অনুদ্ধত, অচঞ্চল, অচপল, যাঁরা সংযতবাক, সংযতেন্দ্রিয় ও মিতাহারী এবং যাঁরা জাগ্রত, স্মৃতিমান, শিক্ষানুরাগী, অবিলাসী, অনলস, দৃঢ়বীর্য, সমাহিত, একাগ্রচিত্ত ও প্রজ্ঞাবান-তাঁরা আছেন আপনার সঙ্গে। তাদের জন্যে নির্বাণ অতি নিকটে ও স্বল্পায়ত্ত।
ভবৎ গৌতম, যেমন সুগন্ধ মূলের মধ্যে কালানুসারী, সুগন্ধ কাঠের মধ্যে রক্তচন্দন এবং সুগন্ধ ফুলের মধ্যে যুঁই শ্রেষ্ঠ, তেমনি আপনার উপদেশ ধর্মোপদেশের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এ উচ্ছ্বাসবাক্য উচ্চারণ করে পরম তৃপ্তি জানিয়ে ব্রাহ্মণ গণক মৌদগল্যায়ন সেই থেকে বুদ্ধের উপাসক হন।