বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের সমস্যা
রপ্তানি বাণিজ্য যে কোনো দেশের জন্যই অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের জন্য তো বটেই, কিন্তু বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের কিছু সমস্যা বিদ্যমান, যার দরুন এ বাণিজ্য আশানুরূপভাবে অগ্রগতি সাধন করতে পারছে না। নিচে সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :
১। রপ্তানি পণ্যের বহুমুখীকরণের অভাব
বাংলাদেশ থেকে যে সকল পণ্য রপ্তানি করা হয় তার সংখ্যা খুবই কম। অর্থাৎ হাতে গোনা গুটিকয়েক পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা হয়। পণ্যের সংখ্যা বৃদ্ধি করে রপ্তানি ব্যবসায়ে বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন অর্থাৎ বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে হবে । অন্যথায় রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা মোটেই সম্ভব হবে না।
আরও পড়ুন: বৈদেশিক বাণিজ্য কি? বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্ব
২। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের নিম্নমান
বাংলাদেশের পণ্যের মান পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় নিম্ন এবং চিরাচরিত ধরনের। নিম্নমানের পণ্যের চাহিদা বিদেশে কম, আবার দামও পাওয়া যায় কম। কিন্তু উৎপাদন ব্যয় কোনো অংশেই কম হয় না। তাই রপ্তানি আয় কম হয়ে থাকে। সুতরাং পণ্যের নিম্নমান ও গতানুগতিকতা রপ্তানি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাধা ।
৩। বৈদেশিক বাজার সম্বন্ধে অজ্ঞতা
বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের চাহিদা থাকে। এক্ষেত্রে কোন দেশে কোন পণ্যের চাহিদা রয়েছে বা কোন পণ্যের বাজার ভাল সে সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে পণ্যের বাজার সম্পর্কে জানা যায় না। ফলে বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের পণ্যের চাহিদার পরিমাণও সঠিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হয় না।
৪। চোরাচালান
বাংলাদেশের রপ্তানিযোগ্য অনেক পণ্য চোরাপথে পাচার হয়ে অন্য দেশে চলে যায়। ফলে দেশে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ কমে যায়। রপ্তানিযোগ্য পণ্যের পরিমাণ কম হওয়ার অর্থ হচ্ছে রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়া আর রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়া মানেই রপ্তানি আয় কমে যাওয়া।
৫। মূলধনের ঘাটতি
বাংলাদেশ অনুন্নত ও দরিদ্র দেশ। এখানে যে কোন ধরনের শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ মূলধনের যোগান সম্ভব হয় না । তাছাড়া রপ্তানি বাণিজ্যেও প্রচুর মূলধনের প্রয়োজন হয়। কারণ রপ্তানি বাণিজ্য তুলনামূলকভাবে ব্যয়বহুল ও ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যথেষ্ট পরিমাণ অর্থসংস্থান না থাকলে সুষ্ঠুভাবে এ বাণিজ্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়।
৬। সরকারি নিয়ন্ত্রণ
বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। অর্থাৎ রপ্তানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে অতিরিক্ত আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। আর এ আনুষ্ঠানিকতা পালনের সুযোগে সরকারি আমলারা নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করে। এতে অনর্থক সময় নষ্ট হয় এবং রপ্তানিকারকগণ বিভিন্ন রকম হয়রানির শিকার হয়।
৭। দক্ষতার অভাব
বর্তমান যুগ হচ্ছে তীব্র প্রতিযোগিতার যুগ। এ যুগে প্রত্যেক স্তরেই যে নীতিটি অনুসরণ করা হয় তা হলো “Survival of the fittest.” সুতরাং বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করে টিকে থাকার জন্য যে ধরনের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন আমাদের দেশের রপ্তানিকারকদের অধিকাংশের মধ্যেই তা নেই।
৮। পণ্যের প্রচারে সীমাবদ্ধতা
বিদেশের বাজারে আমাদের দেশের পণ্যের প্রচার খুব সীমিত। এ দেশের পণ্যের মান ও গুণাগুণ, মূল্য, স্থায়িত্ব ইত্যাদি সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালাতে হবে যাতে বিদেশী ক্রেতাগণ পণ্য সম্পর্কে সম্যক ধারণা অর্জন করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের প্রচেষ্টার যথেষ্ট অভাব রয়েছে।
৯। পরিবহন সমস্যা
বাংলাদেশে যথেষ্ট পরিমাণে পরিবহন মাধ্যম নেই। তাই এ ক্ষেত্রে বিদেশী পরিবহন ব্যবসায়ীদের উপর নির্ভর করতে হয়। এতে রপ্তানি আয়ের একটা বড় অংশ পরিবহন ভাড়া পরিশোধে ব্যয় হয় এবং পরিবহন ১০ মাধ্যমের স্বল্পতার দরুন যথাসময়ে পণ্য বিদেশে প্রেরণ করা সম্ভব হয় না যা রপ্তানি ব্যবসায়ের প্রচুর ক্ষতি করে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের বৈশিষ্ট্য কি কি
১০। অসাধু মনোভাব
অনেক রপ্তানিকারকদের অসাধু মনোভাবের কারণে বিদেশী ক্রেতাগণ এ দেশের পণ্যের উপর আস্থা নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করে। কিন্তু দেশের উপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। কারণ বিদেশী ক্রেতাদের মনে বিরূপ হারিয়ে ফেলে। এ ছাড়াও অসাধ রপ্তানিকারকগণ ওজনের ক্ষেত্রেও কারচুপি করে, মোডকীকরণ ঠিক হয় না ইত্যাদি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলে পণ্যের সুনাম নষ্ট হয় এবং চাহিদা কমে যায়।